ব্যাংকে কি আমার টাকা নিরাপদ?
সাঈদ আল সাহাফ রিয়াদঃ প্রত্যেক ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট-এ বছরে দুইবার ইন্টারেস্টের টাকা ঢুকে। এই টাকাটা আসলে কোথা থেকে আসে? আপনি যেই টাকা ব্যাংকে রাখেন, ব্যাংক কিন্তু সেটা ভল্টে ফেলে রাখে না। টাকাটা ব্যাংক ইনভেস্ট করে। সেখান থেকে একটা আয় আসে। তার কিছু অংশ ব্যাংক টাকার মালিককে দেয়। বাকি টাকা থেকে ব্যাংকের কর্মীদের বেতন, ভবন ভাড়া, অন্যান্য খরচ মেটানোর পর লাভের টাকা শেয়ারহোল্ডারদের মানে ব্যাংক মালিককদের দেয়া হয়। ভল্টে টাকা ফেলে রাখলে সেটা কিন্তু ডিম পাড়বে না, আপনি ইন্টারেস্টও পাবেন না।
ইদানিং কাস্টমারদের মধ্যে আরেকটা খবর রটে গেছে। ব্যাংক কাস্টমারদের টাকা দিতে পারছে না, ফরেন রেমিট্যান্সের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এই ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করি। প্রত্যেকটা ব্যাংকেরই আলাদা ব্রাঞ্চের আলাদা ভল্ট লিমিট থাকে। ছোট ব্রাঞ্চের ভল্ট লিমিট কম। মানে তারা কম টাকা সংরক্ষণ করতে পারে। হুট করে সীমাতিরিক্ত টাকা জমা পড়লে ব্রাঞ্চ সেটা নিজেদের ব্যাংকের অন্য বড় কোনো ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দেয়। ব্যাংকের ভাষায় আমরা এই টাকাকে ‘ক্যাশ রেমিট্যান্স’ বলি। আর যে বড় শাখায় টাকা পাঠানো হয় তাকে ‘ফিডিং ব্রাঞ্চ’ বলা হয়।
ধরেন, একটা ব্রাঞ্চে আপনি ১০০ টাকা রেখেছেন। আপনি যে কোনো সময় সেই টাকা উঠিয়ে ফেলতে পারবেন। কিন্তু সবাই তো একসাথে সব টাকা উঠিয়ে ফেলবে না। তাই যে পরিমাণ টাকা গড়ে ওঠানো হয়, সেই ক্যাশ টাকা রেখে বাকিটা ব্যাংক ইনভেস্ট করে। আবার আপনার ১০০ টাকার পুরোটাও কিন্তু ইনভেস্ট করে না। ১০০ টাকার মধ্যে ১৭ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাকি ৮৩ টাকার মধ্যে, মনে করেন ৭০ টাকা বিভিন্ন জনকে লোন হিসেবে প্রদান করা হয়। বাকি ১৩ টাকা আপনাদের ক্যাশ তোলার জন্য ব্রাঞ্চে সংরক্ষণ করা হয়। এটা বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, জাপান, ফ্রান্স, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, আমেরিকা, কানাডা সবার জন্যই এক নিয়ম। আপনি যে কোনো সময় চেক লিখে কাউন্টারে চলে গেলেই সব টাকা পাবেন না। এটা সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সবার জন্যই সত্য।
তবে আপনি একটু সময় দিলে ব্যাংক অবশ্যই সেটা ম্যানেজ করে দিবে। এক ব্যাংকে টাকা নাই, মানে কোথাও টাকা নাই, এমন না। আমার ব্যাংক থেকে কেউ কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেলে, সেটা অবশ্যই অন্য কোনো ব্যাংকে জমা হবে। সেখান থেকে টাকাটা আবার ঘুরে অন্য ব্যাংকে আসবে। মানে টাকা আপনি পাবেনই।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
মনে করেন, আমার ব্রাঞ্চের ভল্ট লিমিট ১০০ টাকা। এছাড়া প্রতিদিন এভারেজে ৫০০ টাকা জমা হয়, ৫০০ টাকা উত্তোলন হয়। এখন হুট করে একদিন জমা দিতে কেউ আসলো না। কিন্তু অনেকেই টাকা তুলতে চলে এসেছে। সেদিন স্বাভাবিকভাবে সবাইকে পেমেন্ট করা সম্ভব হবে না। তবে আপনি সময় দিলে, যে শাখায় টাকাটা বেশি জমা পড়েছে, সেখান থেকে ম্যানেজ করে দেয়া যাবে। এটা সাময়িক সমস্যা। এটা সব ব্যাংকেই হয়। যারা নিয়মিত লেনদেন করেন, তারা ভালো করেই জানেন। এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আরও দেখুন:
◾ সংকটে ব্যাংকের ওপরই ভরসা রাখুন
আরেকটা ব্যাপার বলি, ধরেন আপনার অ্যাকাউন্ট জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিসে। সিটি ব্যাংক থেকে কিংবা জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখায় আপনার অ্যাকাউন্টে বড় অংকের টাকা ডিপোজিট হয়েছে। আপনি সেই টাকাটা লোকাল অফিস থেকে কিংবা নারায়নগঞ্জ শাখা থেকে তুলতে চাচ্ছেন। টাকাটা আছে চট্টগ্রামে এখন সাথে সাথে আপনি ব্যাংকে চলে গেলে কিন্তু এতো ক্যাশ টাকা নাও থাকতে পারে। আপনাকে ম্যানেজ করার জন্য সময় দিতে হবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ক্যাশ চাইলে যে কোনো ব্রাঞ্চের হাতেই ক্যাশের শর্টেজ থাকতে পারে। আপনি টাকাটা তুলে নিশ্চয়ই অন্য কাউকে দিবেন। সে সেটা আবার অন্য কোথাও জমা দিবে। তাহলে অনলাইনে কয়েক মিনিটেই টাকাটা ট্রান্সফার করে ফেলতে পারেন। দুইজনের একই ব্যাংক হলে ফান্ড ট্রান্সফার করবেন, আলাদা ব্যাংক হলে আরটিজিএস করবেন। আপনার টাকা জায়গামতো নিরাপদে পৌছে যাবে। জীবনের ঝুকি নিয়ে, হয়রানি হয়ে ক্যাশ নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন না।
এবার ফরেন রেমিট্যান্স নিয়ে একটু কথা বলি। বিদেশ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কিংবা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, রিয়া, মানিগ্রাম, ট্রান্সফাস্ট ইত্যাদি নানান উপায়ে গোপন নাম্বারের মাধ্যমে আপনার টাকা আসতে পারে। এগুলো সব বৈধ উপায়। এসবের মাধ্যমে আপনার প্রিয়জন আপনার কাছে ডলার পাঠায়, সরকার বাজারদর থেকে ২.৫% বেশি দিয়ে আপনার কাছ থেকে সেই ডলারটা কিনে নেয়। কারণ সরকারের বা দেশের বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে ডলার লাগবে। আপনি নিশ্চয়ই টাকার বান্ডিল দিয়ে আমেরিকা থেকে পণ্য কিনতে পারবেন না। বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার সেতু বানালে সে নিশ্চয়ই টাকা নিবে না, সে ডলারই নিবে। তাই দেশের ডলারটা প্রয়োজন।
এদিকে বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর আরেকটা জনপ্রিয় উপায় আছে। হুন্ডি। এটা একটা অবৈধ প্রক্রিয়া। দাঁড়ান পুরো প্রক্রিয়াটা ব্যাখ্যা করছি।
মনে করেন, আপনার ভাই সিঙ্গাপুর বা আমেরিকা থাকে। সে প্রতিমাসে আপনার কাছে রেমিট্যান্স পাঠায়। এদিকে চৌধুরী সাহেব ঘুষ খেয়ে, জমি দখল করে, চুরি-ডাকাতি করে প্রচুর পরিমান অবৈধ টাকা আয় করেছে। চৌধুরী সাহেব ২০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী। তার অবৈধ কোটি কোটি টাকা ব্যাংকেও জমা করতে পারে না। কারণ ব্যাংক জিজ্ঞেস করে, এতো টাকা কোথায় পেলেন। সেই এই টাকায় বাড়ি-গাড়ি-জমি কিনতে পারে না। কারণ ইনকাম ট্যাক্স বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জিজ্ঞেস করবে, এই টাকার উৎস কী? সে তার অবৈধ টাকা খাটের নিচে, বালিশের মধ্যে, চালের ড্রামে লুকিয়ে রেখেছে। সে চান্সে আছে টাকাটা কানাডা পাঠিয়ে বেগমপাড়ায় একটা বাড়ি কিনবে। কিন্তু বেগমপাড়ার বাড়িওয়ালা তো আর টাকা নিবে না। তার দরকার ডলার। বস্তাভর্তি ডলার নিয়ে এয়ারপোর্ট দিয়ে কানাডার বিমানেও ওঠা সম্ভব না। তাহলে করণীয় কী?
সে যোগাযোগ করবে আপনার ভাইয়ের কাছে। আপনার ভাই ১ লক্ষ টাকা পাঠালে সরকার আপনাকে ১ লক্ষ ২ হাজার ৫ শত টাকা দিবে। এদিকে চৌধুরী সাহেব আপনার ভাইকে বললো, “আপনি ডলারটা আমার কানাডার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেন। আর আমি আপনার ভাইকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছি।”
সাড়ে সাত হাজার টাকা বেশি পেয়ে আপনি খুশি, বিনা খরচায় টাকা পাঠিয়ে আপনার ভাইও খুশি, অবৈধ টাকা ব্যবহার করতে পেরে চৌধুরী সাহেবও খুশি। তিনজনেরই লাভ হয়েছে। তাহলে লসটা আসলে কার? লসটা হলো দেশের। কীভাবে?
সরকারের কাছে যে ডলারটা আসার কথা ছিলো সেটা আসেনি। সেটা কানাডায় চৌধুরী সাহেবের অ্যাকাউন্টে ঢুকে গেছে। এটাই ডলার পাচার। ফলে সরকার তার পরিকল্পনা মতো কাজটা করতে পারবে না। ধরেন সরকারের আরেকটা পদ্মাসেতু বানানোর ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু হাতে ডলার না থাকলে দামি দামি বিদেশী মেশিন কিনবে কোথা থেকে? পদ্মা সেতু হলো না। সরকার যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তার জন্য অনেককিছু বিদেশ থেকে কিনতে হয়। কিন্তু সরকারের কাছে ডলার না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে আপনি-আমি লোডশেডিংয়ে বসে আছি। আপনার স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের জটিল রোগের জন্য একটা বিদেশী ওষুধ দরকার। সেটা আপনি সারা দেশ খুঁজেও পাবেন না।
কারণ ডলার না থাকায় ইমপোর্টাররা কেউ সেটা বিদেশ থেকে আনতে পারেনি। কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কা কাগজ কিনতে না পারায় স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা নিতে পারেনি। এভাবে তাদেরর ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে। আলটিমেট দেশের ক্ষতি মানে আপনারই ক্ষতি। আপনি এক লাখের জায়গায় এক লাখ দশ হাজার টাকা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। এবার বুঝেন মজা।
আরেকটা প্রশ্নের উত্তর কিন্তু পেয়ে গেছেন। ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। এই গুজবটা আসলে কে ছড়িয়েছে? উত্তর: চৌধুরী সাহেব। কারণ তখন আপনি ভয় পেয়ে আপনার টাকা ব্যাংকে না পাঠিয়ে হুন্ডি করবেন। আপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করে কামানো বৈধ টাকাটা, অবৈধ উপায়ে দেশে পাঠিয়ে চৌধুরী সাহেবের ডলার পাচারে সহায়তা করলেন।
আবার ফিরে আসি ব্যাংকের টাকা উত্তোলনে। আপনি ভয় পেয়ে আপনার জমানো সব টাকা ব্যাংক থেকে তুলে আপনার ঘরের কাঠের আলমারিতে তুলে রাখলেন। চোর-ডাকাতরা তো এটাই চায়। সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী, ২৪ ঘন্টা সিসি ক্যামেরা, সেন্সর, বিশেষভাবে তৈরী ব্যাংকের অত্যাধুনিক ভল্ট থেকে টাকা ডাকাতি কঠিন হলেও, আপনার আলমারি ভাঙ্গা কোনো ব্যাপারই না।
লাভবান পার্টি আরও আছে। আপনি এবার টাকাটা রাখবেন এলাকার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে। আপনি টাকাটা রাখবেন, পিপলস লিজিংয়ে। এসবে ব্যাংকের চেয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ লাভ দেয়। একদিন শুভ সকালে দেখবেন, মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ নাই, পিপলস লিজিং নাই, আপনার টাকাও নাই।
কিন্তু টাকাটা ব্যাংকে থাকলে ব্যাংক সেটা ইনভেস্ট করতে পারতো, অনেক কোম্পানি হতো, অনেকের কর্মসংস্থান হতো, অনেক সংসার সচ্ছল হতো, কোম্পানিগুলো উৎপাদিত পণ্য বিদেশে এক্সপোর্ট করতে পারতো। সেই ডলার দিয়ে আরেকটা পদ্মাসেতু হতো, আরেকটু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতো, আপনার অসুখের সময় দুষ্প্রাপ্য বিদেশী ওষুধ কেনা যেতো। আপনিও বাঁচতেন, দেশও বাঁচতো।
তাই হুজুগে পড়ে নিজের বৈধ টাকা হুন্ডিতে পাঠিয়ে অবৈধ করবেন না। চিলে কান নিয়েছে শুনে দৌঁড়ে ব্যাংকে এসে এফিডিআর, ডিপিএস ভেঙ্গে চালের ড্রামে টাকা রাখবেন না। বাংলাদেশের ৫১ বছর বয়সে একটা ব্যাংক এখন পর্যন্ত বন্ধ হয়নি, হবেও না। আপনার টাকার নিরাপত্তা ব্যাংকের চেয়ে বেশি অন্য কেউ দিতে পারবে না। হ্যাপি ব্যাংকিং।
লেখকঃ সাঈদ আল সাহাফ রিয়াদ