ইসলামী ব্যাংকিং

মোহাইমিনের শুভংকরের ফাঁকি ও ইসলামী ব্যাংকিং: ৪র্থ পর্ব

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ জনাব মোহাইমিন অভিযোগ করেছেন, ইসলামী ব্যাংক ব্যবসায় কোন ঝুঁকি নেয়না, ব্যবসার নামে নাটক করে, ব্যবসার আড়ালে বাহানা করে এবং আরো সাংঘাতিক কথা যে এরা সুদকে হালাল জাস্টিফাই করে। এসব কথার স্বপক্ষে তিনি তার বই’র ২৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছেন-

Quote
আধুনিকতার নামে ব্যাংকিং এবং ব্যবসা এক হয়ে যাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর জানাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল করে দেখুন, ব্যাংক একজন প্রচলিত ব্যবসায়ীর মতো ঝুঁকি বহন করে না। গাড়ি ব্যবসায়ীর কথাই যদি চিন্তা করেন, তিনি ফ্যাক্টরি থেকে গাড়ি কিনে দোকানে সাজিয়ে রাখেন, ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করেন, পণ্য চুরি হওয়ার আশঙ্কা করেন, আগুন লাগার ব্যাপারে ভয়ে ভয়ে থাকেন, আরো কত কী! সেই তুলনায় একটি ব্যাংক মাল বিক্রি নিশ্চিত করেই মাল অর্ডার করে এবং মালিকানা হাতে আসার সাথে সাথে ত্বরিত গতিতে মালিকানা পরিবর্তন করে ফেলে। ঝুঁকি বলতে থাকে কেবল টাকা ফেরত না পাওয়া। কিন্তু অন্য সব ব্যাংকেরই এই ঝুঁকি থাকে। এবার একটু ভাবুন তো, এত অল্প ঝুঁকিতে এত লাভজনক কোনো ব্যবসা যদি পৃথিবীতে থাকত, সবাই কি এই ব্যবসাই করত না? কিন্তু সবাই কেন তা করছে না? করছে না কারণ এটি কোনো ব্যবসাই না। এখানে কেবল ঋণ আদান প্রদান হচ্ছে। ব্যবসার নাটকটা করা হচ্ছে সুদকে হালাল বানানোর উদ্দেশ্যে। ঋণ দাতা কিংবা ঋণ গ্রহীতা কারোরই ব্যবসা করার নিয়ত নেই। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম তাই আল্লাহর আইন অনুযায়ী পবিত্র থাকার জন্য ব্যবসার নাটক সাজানো হচ্ছে; এজন্যই একটি প্রচলিত ব্যাংকের মডেলের সাথে আমরা যখন কোনো ইসলামি ব্যাংকের মডেলের তুলনা করি, সামান্য কিছু প্রক্রিয়াগত তফাত ছাড়া আর কোনো তফাতই নজরে পড়ে না।
Unquote

These are all Primary understanding, এগুলো কোন ব্যাংকিং বুঝের কথা নয়। ব্যাংক গ্রাহকের সাথে যে কোন বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত উপনীত হবার আগেই অনেক ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে। অনিশ্চয়তা থেকে ক্ষতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাকে ঝুঁকি বলে। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করে, তার ফলে যে ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকির সৃষ্টি হয়, তার সমষ্টিকে পোর্টফোলিও ঝুঁকি বলে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে পোর্টফোলিও ঝুঁকির সৃষ্টি হয়, কারণ ব্যাংক বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ প্রদান করে। ফলস্বরূপ, পোর্টফোলিও ঝুঁকি গঠনের মাধ্যমে বিনিয়োগের ঝুঁকি হ্রাস করা ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ব্যাংকিং কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার জন্য ঝুঁকি পরিমাপ করতে হয়। এটা প্রথম পর্যায়ের ঝুঁকি নিরুপনের কাজ যা বিনিয়োগ দিবার আগেই ব্যাংকারকে করতে হয়। বিনিয়োগ চলমান অবস্থার ঝুঁকি আর বিনিয়োগ মেয়াদ উত্তর ঝুঁকি এক ও অভিন্ন নয়।

প্রধানতঃ তিনটি ঝুঁকির বিষয়ে ব্যাসেল নীতিমালায় আলোচনা করা হয়েছে। সেগুলো হলো ক্রেডিট বা ঋণ ঝুঁকি, অপারেশনাল বা পরিচালনাগত ঝুঁকি ও মার্কেট বা বাজার ঝুঁকি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

অপারেশনাল বা পরিচালনাগত ঝুঁকির মধ্যে আছে-
১. অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জালিয়াতি,
২. আইন ঝুঁকি,
৩. ক্ষতি, শ্রম ও স্বাস্থ্য,
৪. শারীরিক সম্পদের ক্ষতি এবং
৫. ব্যবসায়িক বাধা।

মার্কেট বা বাজার ঝুঁকিগুলো হলো-
১. রিটার্ণের ঝুঁকি,
২. ইক্যুইটি অবস্থানের ঝুঁকি,
৩. বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি এবং
৪. পণ্য ঝুঁকি।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা মানুষের আমানতসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণের পর তা ফেরত দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকের আমানতকৃত অর্থ যাতে তছরুপ না হয়, সে বিষয় এবং উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তা সংরক্ষণ করাও ব্যাংকগুলোর নৈতিক দায়িত্ব।

‎اِنَّ اللّٰہَ یَاۡمُرُکُمۡ اَنۡ تُؤَدُّوا الۡاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَہۡلِہَا ۙ وَاِذَا حَکَمۡتُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ اَنۡ تَحۡکُمُوۡا بِالۡعَدۡلِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ نِعِمَّا یَعِظُکُمۡ بِہٖ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে বিষয়ে উপদেশ দেন, তা কতই না উৎকৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।
(আন নিসা – ৫৮)

ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো, আমানতকৃত অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। যে কোনো দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে উৎপাদনশীল শিল্প-কারখানাগুলো, যারা আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। সামাজিক কল্যাণ সাধন ও জাতীয় আয় বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচ্ছন্ন ও নিখুঁত হওয়া জরুরি। সে লক্ষ্যে আমাদের দেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রম বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততা ও নৈতিকতার গুণ সৃষ্টি করা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। প্রচলিত ব্যাংকিং ধারায় ওইসব কাজ করা জরুরি নয়। কারণ প্রচলিত ব্যাংকগুলো যে কোনো খাতে বিনিয়োগে আইনগত কোনো বাধা নেই। যার ফলে প্রচলিত ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ বা বিনিয়োগে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি থাকে। অন্যদিকে শরিয়াহ সম্মত ব্যাংকিং দ্ধারা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ তুলনামূলক কম। সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিনিয়োগ করলে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে; অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হ্রাস পাবে। আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ী সামর্থ্য থাকার পরও যথাসময়ে ঋণের বা বিনিয়োগের টাকা পরিশোধ করেন না। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, সেই সঙ্গে ক্রেডিট বা বিনিয়োগ ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরও দেখুন:
✓ মোহাইমিনের শুভংকরের ফাঁকি ও ইসলামী ব্যাংকিং: ৩য় পর্ব

ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা মোকাবিলার জন্য ১৯৭৪ সালে গঠিত ‘ব্যাংকিং কমিটি অব ব্যাংকিং সুপারভিশন (বিসিবিএস)’ নামে ব্যাসেল কমিটি ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে ব্যাসেল-১ মূলনীতি জারি করে, যা ভারত ১৯৯৯ সালে গ্রহণ করে। এই ব্যাসেল আদর্শ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রথমে ব্যাসেল-১ বাস্তবায়ন করা হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তুলনায় ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ৮ শতাংশ। ২০০৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হার ১০ শতাংশ করা হয়। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ মূলধনের সঙ্গে আরও ২.৫০% মূলধন বাড়ানোর জন্য নীতিমালা করা হয়। অতিরিক্ত ২.৫০% মূলধনের বিশেষ নাম দেয়া হয়েছে তা হলো Capital Conservation Buffer. এটা নির্ধারিত হবে Risk Weighted Asset এর বিপরীতে। সে ক্ষেত্রে ২.৫০% কে ৪ দিয়ে ভাগ করে প্রত্যেক বছর ০.৬২৫ শতাংশ হারে পর্যায়ক্রমে বাড়াতে হবে। যদি কোনো ব্যাংকের ক্যাপিটাল এর নিচে নেমে যায়, তবে সে ব্যাংক সে বছর কোনো প্রকার ডিভিডেন্ট প্রদান করতে পারবে না।

বিশ্বের যেকোনো ব্যাংকের মূলধনের পরিমাপক হলো মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (CAR)। এ অনুপাতকে আমানতকারীদের সুরক্ষা, ব্যাংকের স্থিতিশীলতা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে ব্যাংকের সিএআর যত বেশি, অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সে ব্যাংকের সক্ষমতা ততটাই শক্তিশালী। যদিও এক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো। পরিসংখ্যান বলছে, মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাতের দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর ব্যাংকের তুলনায় বহু পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও এক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থান একেবারেই তলানিতে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের সিএআর হওয়ার কথা সাড়ে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে এটি ১১ শতাংশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। যদিও প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে এ অনুপাত ১৭, শ্রীলংকায় ১৬ দশমিক ৫০ ও ভারতে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ।

ব্যাংকিং বাজারে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতার কারণে, বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক ক্রেডিট ঝুঁকি মূল্যায়নে দৃঢ়ভাবে মনোনিবেশ করছে। ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনার কারণে ক্রেডিট ঝুঁকি দেখা দেয়। ক্রেডিট ঝুঁকির দুর্বল ব্যবস্থাপনা থেকে উদ্ভূত সাম্প্রতিক বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর, এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং শিল্পে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ব্যাঙ্কের ক্রেডিট পোর্টফোলিওর গুণমান নির্ধারণের প্রাথমিক ফ্যাক্টর হল প্রতিটি ঋণগ্রহীতার যথাসময়ে, ব্যাংকের কাছে করা সমস্ত Credit Commitment সম্মান করার ক্ষমতা। একটি ক্রেডিট প্রস্তাব মূল্যায়ন করার সময় অন্তর্নিহিত সিকিউরিটিজগুলির আদায় সম্ভাবনার পরিবর্তে ঋণগ্রহীতার ব্যবসা (নগদ প্রবাহ) থেকে উৎপন্ন তহবিল থেকে ঋণের পরিশোধের সম্ভাবনার উপর আরও জোর দেওয়া। ঋণগ্রহীতার আর্থিক স্বাস্থ্য এবং ঋণের বাধ্যবাধকতা পরিশোধের ক্ষমতার একটি আনুষ্ঠানিক মূল্যায়নকে ক্রেডিট রেটিং বলা হয় যা ব্যাংককে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে গ্রেড করতে সাহায্য করে।

আসুন, এতোসব বিশ্লেষণের পর আপনি পজিটিভ পেয়ে বিনিয়োগ মন্জুরী দিলেন। এখন মালামাল কিনা ও হস্তান্তরের বিষয়। এটা দু’ভাবে হতে পারে। একটা হলো যদি ক্রয়কৃত মালামাল গ্রাহকের তত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সেটাকে ব্যাংকের ভাষায় Hypothecation বলে যেখানে মালামাল হস্তান্তরের সাথে সাথে সংরক্ষনগত যাবতীয় ঝুঁকিও হস্তান্তর হয়ে যায়। এটাই যুক্তিযুক্ত। মাল গ্রাহকের কব্জায় রেখে ব্যাংক তার ক্ষতির দায় নিতে পারে না। এটি ইনসাফের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। আর মালামাল ব্যাংকের গুদামে সংরক্ষন করা হলে ক্ষতি-নিত ঝুঁকি ব্যাংকের ঘাড়ে। তখন তা ইনস্যুরেন্স দ্বারা কাভার্ড করা হয়, এটাই দেশের নিয়ম ও প্রাকটিচ। বড় বড় কারখানার ওয়ার্কিং ক্যাপিটেলে আনা Raw Material আপনি গুদামে প্লেজ রাখতে পারেন না, তাতে উৎপাদনের ক্ষতি হয়। আবার রাস্তার চলমান গাড়িতে বিনিয়োগ দেয়া হলে সে গাড়ীও আপনি প্লেজে রাখতে পারেন না, এটা অস্বাভাবিক। এগুলো যত দ্রুত গাহককে বুঝিয়ে দেয়া যায় তত দ্রুত পারফরমিং করে। যেটা মোহাইমিন বলেছেন Risk Transfer. তিনি ব্যাংকের স্টাফ হলে হয়তো এত সহজে একথা বলতে পারতেন না। তাত্বিক হয়ে অনেক নসীহতই বিনা ঝুঁকিতে বর্ষণ করা যায় কিন্ত প্রাকটিক্যাল তো তত সহজ নয়।

এরপর আসি “গ্রাহকের ক্ষতিজনিত ঝুঁকি ব্যাংক নেয়না”-এ অভিযোগের জবাবে। জী, ব্যাংক নিশ্চয়ই সে ঝুঁকিও নেয় হয়তো তা আপনার জানা নেই। ব্যাংক যেসব মোডে কাজ করে তার মেক্সিমামই ট্রেডিং বা বেচারেনা সুরতের, “বাইয়া” ম্যাকানিজমের। এখানে বেচাকেনা সম্পন্ন হবার পরপরই মালামাল গ্রাহক বুঝে নিয়ে চলে যায়।ধরুন নিউমার্কেট বা গাউসিয়ার একজন পাইকার সব মালামাল বুঝে পেল, ফিজিক্যাল বা ডকুমেন্টেড যে আকারেই হোক, তার দোকানেও উঠালো। এখন আল্লাহ না করুন কোন কারণে আগুন লেগে ভস্মীভূত হলো। তাহলে ব্যাংক এ ক্ষতি বহন করবে কিনা? এর উত্তর আপনিই দিন। আপনি দোকান থেকে দশটি ডিম কিনে আনলেন, পথিমধ্যে পাঁচটি ভেংগে গেলে আপনি দোকানীর কাছে তা দাবী করেন কি? তবুও ব্যাংক মানবিক দৃষ্টিভংগীতে অনেক কিছু বিবেচনায় নেয়। তার মুনাফা ছেড়ে দেয়, লিমিট চলমান রেখে বা লিমিট বাড়িয়ে ব্যবসা চলমান রাখে, কোলেটারেল কম্প্রোমাইজ করে। এমন বহু নজীর রয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি.-এর মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করা যে সব প্রকল্পে লোকসান হয়ে থাকে, সেই লোকসানের ভাগ ইসলামী ব্যাংক আগেও নিতো এখনও নেয়। অবশ্য বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করার কারণে অধিকাংশ প্রকল্পই লাভে থাকে। সে কারণে লোকসানে পড়া প্রকল্প নিয়ে ও লোকসানের ভাগ নেওয়ার আলোচনা খুব একটা আসে না। সাধারনতঃ লাভ ভাগাভাগিতে যেতে চায় না গ্রাহক। তাতে তার ধারনা, বেশী লাভ হলে ব্যাংক বেশী পূজিদাতা বলে বেশী লাভ পাবে।

মুশারাকা হলো অংশীদারের ভিত্তিতে ব্যবসা করা। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়ই মূলধন প্রদান করবে এবং চুক্তি অনুযায়ী মুনাফা বণ্টন করবে। কিন্তু ক্ষতি হলে মূলধনের অনুপাতে ক্ষতিও বহন করবে দু’পক্ষ। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এর পরিবর্তে মুরাবাহা বা ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছে বেশি।

দ্বিতীয়ত, গ্রাহকদের লোকসান দেখানোর প্রবণতাও মুশারাকা কমে যাওয়ার জন্য দায়ী। প্রথম দিকে ইসলামী ব্যাংকগুলো যখন মুশারাকা পদ্ধতিতে বিপুল বিনিয়োগ করতে লাগলো, তখন অধিকাংশ গ্রাহকই তাদের ব্যবসায় লোকসান দেখাতো। প্রকল্প পরিচালনায় গাফিলতিও দেখা যেতো। আবার আয়-ব্যয়ের হিসাবে মিথ্যার আশ্রয় নিতো গ্রাহক। আবার ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পক্ষেও প্রজেক্টগুলো সার্বক্ষণিক তদারকি করা ছিল অসম্ভব। এ কারণে ব্যাংকের জন্য ক্রমশ এ পদ্ধতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এতে ব্যাংকও মুশারাকা পদ্ধতি থেকে সরে আসতে থাকে।

ইসলামী ব্যাংকের অনেকগুলো বিনিয়োগ পদ্ধতির মধ্যে মুশারাকাও আছে। এই পদ্ধতির চেয়ে বাই মুরাবাহা বা ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি এখন জনপ্রিয়। কারণ, মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যাংক লাভবান হয় বেশি। বাই মুরাবাহায় উদ্যোক্তারা লাভবান হন বেশি। তবে এখনও মুশারাকা পদ্ধতিতে কোল্ড স্টোরেজ, রফতানিমুখী গার্মেন্ট খাতসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে।’

প্রসঙ্গত, মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ দিতে গেলে ব্যাংক গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা, তিনি দ্বীনদার কিনা, তার কর্মদক্ষতা, হিসাব সংরক্ষনে সততা ও ব্যবসাজনিত Shock Absorbing Capacity ইত্যাদি পর্যালোচনা করে আস্থা রাখার মতো হলে তবেই বিনিয়োগ করে ব্যাংক। সুতরাং “কোন ব্যবসাতেই ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকের লস নেয়না” এমন অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। আপনি ক্রমাগত লস বয়ে যাবেন, জনগণের আমানতের এমন বেউকুভ ও বেইনসাফপূর্ণ (!!) ব্যবসায়ের জন্য নিশ্চয়ই আপনাকে আমানতকারীরা ব্ল্যাংক চেক দেয়নি, আর বাংলাদেশ ব্যাংকও তা অনুমোদন করেনা।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button