ইসলামী ব্যাংকিং

মোহাইমিনের শুভংকরের ফাঁকি ও ইসলামী ব্যাংকিং: ২য় পর্ব

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ পূর্বস্থিরকৃত ধারনা (Pre conceived notions) সব সময় উত্তম ফলাফল দেয়না বরং ঘুরেফিরে সেই পূর্বের “স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র”র কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে। মোহাইমিন সাহেবও সুদভিত্তিক ব্যাংকের Debtor-Creditor relationship এর চক্কর থেকে বের হতে পারলেন না বরং তার ৯৪ পৃষ্ঠার বইটির আদ্যোপান্ত এই সম্পর্কের দোলাচলেই তিনি নিমগ্ন ছিলেন। গত পঞ্চাশ বছরে দেশ বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় Banker Customer Relationship in Islamic Banking নিয়ে প্রচুর গবেষণা কর্ম হয়েছে, প্রচুর আর্টিকেলও উপস্থাপন ও পড়া হয়েছে তার থেকে তিনি বরং উপকৃত হতে পারতেন।

উল্টো তিনি তার ঐ পূর্বস্থিরকৃত ধারনার কারণে ইসলামী ব্যাংকের টার্মগুলোরও সমান ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ফলশ্রুতিতে তার উপসংহার হয়েছে- আপনি আপনার টাকা ইসলামি ব্যাংকে রেখেছেন কি সুদি ব্যাংকে রেখেছেন তার মাঝে বিশেষ কোনো পার্থক্য আমি দেখি না। তাই যেই ব্যাংকের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ভালো সেখানে ডিপোজিট করলে দুনিয়ার জন্য উত্তম। আখিরাতের কথা চিন্তা করলে ব্যাংক ডিপোজিট যত কমানো যায় তত ভালো। (পৃষ্ঠা ৬৭)এ প্রসংগে বিশেষ একটি পর্বে আলোচনা করবো। এখন আমরা দেখি আসলে গ্রাহক – ব্যাংকার রিলেশন সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবস্থান কি?

প্রচলিত ব্যাঙ্কগুলি সুদ-ভিত্তিক সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে যার আয়ের প্রধান উৎস হল সুদ। ব্যবসায়িক সত্তা হিসাবে প্রচলিত (বাণিজ্যিক এবং খুচরা) ব্যাঙ্কগুলি অন্য ব্যাঙ্ক বা ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে যা ধার করেছে তার চেয়ে তারা ধার দেওয়া অর্থের উপর উচ্চ হারে সুদ চার্জ করে অর্থ উপার্জন করে (যেমন বন্ধকী, ক্রেডিট কার্ড সুবিধা ইত্যাদি) তাদের উদাহরণস্বরূপ, যদি প্রচলিত ব্যাংকগুলি আমানতের উপর ১% সুদ দেয়, তবে তারা ঋণের উপর ৬% সুদ নিতে পারে। তারা ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে তাদের অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য প্রদত্ত পরিষেবার জন্য ফিও নেয় এবং সেইসাথে সম্মত সীমা অতিক্রম করে ওভারড্রাফ্টের উপর আরোপিত ব্যাঙ্ক চার্জ থেকে অর্থ উপার্জন করে। সূদ ভিত্তিক ব্যাংক আপনার টাকা কোথায় খাটাবে সে অধিকার তাদের। সেটা দিয়ে কি সিনেমা বানাবে না জুয়া খেলবে, আপনার জানবার কিছু নেই।

The money placed in the custody of a banker is, to all intents and purposes, the money of the banker, to do with it as he pleases; he is guilty of no breach of trust in employing it; he is not answerable to the principal if he puts it into jeopardy, if he engages in a hazardous speculation; he is not bound to keep it, or deal with it, as the property of his principal, but he is of course answerable for the amount, because he was contracted, having received that money, to repay to the principal, when demanded, sum equivalent to that into his hands.

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এই ধরনের সম্পর্কের উদ্ভব হয় দেনাদার-পাওনাদারের মধ্যে যে “টাকাটি ব্যাংকের এবং ব্যবহারের জন্য ব্যাংক স্বাধীন। এটা যেমন তিনি উপযুক্ত দেখেন; তিনি আমানতকারীদের অর্থ নিয়োগে বিশ্বাসভঙ্গের জন্য দোষী নন; যদি তিনি অর্থ ঝুঁকির মধ্যে রাখেন তবে তিনি জবাবদিহি করবেন না, তবে ব্যাংকার তার আমানতকারীর চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধ করতে বাধ্য এবং যদি তা সম্মত হয় তবে সুদ মঞ্জুর করা হয়”। একইভাবে, যখন ব্যাংকগুলি গ্রাহকদের ঋণ ও ঋণ সুবিধা প্রদান করে, তখন চুক্তিভিত্তিক সম্পর্কটি হয় পাওনাদার-দেনাদারের সাথে, ব্যাংক হিসাবে পাওনাদার এবং গ্রাহক হিসাবে ঋণী সুতরাং, এটি আইনের একটি স্থির অবস্থান যে ব্যাংকে জমা করা টাকা ব্যাংকের টাকায় পরিণত হয় এবং গ্রাহক ব্যাংকের পাওনাদার হয়ে যায়।

আধুনিক বিশ্বের বিষয়গুলি সুদের (রিবা) উপর নির্ভরশীল, তবে ইসলামে এটি নিষিদ্ধ (হারাম)। ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় (রিবা) সম্পূর্ণরূপে এড়ানোর জন্য, ইসলামী ব্যাংকিং অনুশীলনকারীরা লেনদেনের বিভিন্ন পদ্ধতি তৈরি করেছেন যেগুলিকে শরিয়াহ সম্মত বলে দাবি করা হয় যা প্রাথমিকভাবে ইক্যুইটি-ভিত্তিক লাভ-লোকসান-বন্টন (PLS) অর্থায়ন মোডের ভিত্তিতে। অত:পর, ইসলামী ব্যাংকগুলি বিনিয়োগ অ্যাকাউন্টে নিজেদের এবং আমানতকারীদের মুনাফা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ করার উদ্যোগ নেয় কারণ তারা টাকা ধার দিয়ে সুদ উপার্জন করতে পারে না।

ইসলামী চুক্তি নীতির উপর ভিত্তি করে PLS ইক্যুইটি-ভিত্তিক বিনিয়োগ পদ্ধতি, ইসলামী ব্যাংকিং নিয়মাচারের অধীনে ব্যাংকার এবং গ্রাহকের সম্পর্ককে প্রচলিত ব্যাঙ্কগুলির থেকে আলাদা করে তোলে। ব্যাঙ্ক এবং গ্রাহকের মধ্যে সম্পর্ক বিশেষ যা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত শরীয়া নীতির কারণে হয়। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্ক প্রাথমিকভাবে দেনাদার-পাওনাদার সম্পর্ক নয় বরং এটি একটি ভিন্ন ইক্যুইটি-ভিত্তিক চুক্তির উপর ভিত্তি করে যেখানে ব্যাংকগুলি ইক্যুইটি-ভিত্তিক কোম্পানির মতো কাজ করে এবং আমানতকারীদের আধা-শেয়ারহোল্ডার হিসাবে গণ্য করা হয়। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কগুলি একটি PLS আয় ভাগাভাগি ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় যাতে ব্যাংকিং চুক্তিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সুদ (রিবা), জুয়া (মায়সির), অনিশ্চয়তার উপাদান (ঘারার) এবং জল্পনা-কল্পনার (স্পেকুলেশান) মতো অন্যায্য শোষণমূলক উপাদানগুলি এড়ানো যায়।

ইসলামিক ব্যাংকিং প্রোডাক্টগুলিও অনন্য কারণ দেশ বা বিশ্ব জুড়ে সর্বজনীন ইসলামিক ব্যাংকিং পণ্য হিসাবে এগুলো ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ হল যে পণ্যগুলি ব্যাঙ্ক থেকে অন্য ব্যাঙ্কে নাম এবং প্রকৃতিতে সমান। সুতরাং এটা বলা যেতে পারে যে শরীয়াহ নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেশ কয়েকটি অন্তর্নিহিত শরীয়াহ চুক্তি একটি পণ্য তৈরি করতে একত্রিত হয়। এখানে বিভিন্ন “স্কুল অব থট” কুরআন ও হাদীসের স্পিরিটের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করে। এই ধারণা প্রচলিত ব্যাংকের থেকে ভিন্ন।

আরও দেখুন:
✓ মোহাইমিনের শুভংকরের ফাঁকি ও ইসলামী ব্যাংকিং: ১ম পর্ব

এই PLS মোডগুলির মূল বিষয়গুলি সাধারণত ট্রাস্টি-ভিত্তিক অংশীদারিত্বের বিভিন্ন রূপ হিসাবে উপস্থাপন করা হয় যেমন মুদারাবাহ (লাভ ভাগাভাগি) এবং ইক্যুইটি-ভিত্তিক অর্থায়ন যেমন মুশারকাহ (যৌথ উদ্যোগ) মুরাবাহাহ (খরচ প্লাস), ইজারাহ থুম্মা আল বাই’ (ভাড়া ক্রয়), বাই মুআজ্জাল (বিলম্বিত বিক্রয় চুক্তি) ইত্যাদি। ইসলামিক ব্যাংকের অন্যান্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওয়াদিয়াহ ইয়াদ আল আমানাহ (গ্যারান্টি সহ নিরাপদ রক্ষণাবেক্ষণ), হাওয়ালাহ এবং কারদ (সুদমুক্ত অর্থায়ন) কয়েকটি নাম। যদিও ইসলামী ব্যাংকগুলো উচ্চ লিভারেজকে নিরুৎসাহিত করে কিন্তু তাদের কর্পোরেট ফাইন্যান্স কৌশল মুদারবাহ এবং মুশারাকাহ-এর ইক্যুইটি-ভিত্তিক অর্থায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের বিচক্ষণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে।

ইসলামী অর্থব্যবস্থারই অবিচ্ছেদ্য অংশ ইসলামী ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স যা প্রচলিত সুদ নির্ভর ব্যাবস্থা থেকে একেবারেই আলাদা। কাজেই আপনি সুদী ব্যবস্থা দিয়ে ইসলামী ব্যবস্থাকে তুলনা করলে তা আপনাকে বিপজ্জনক উপসংহারে পৌছাবেই।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button