মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকিং সুদহার
অন্জন কুমার রায়ঃ করোনা মহামারীর কারণে ২০২০-২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বিশ্ব যখন উন্মুখ, তখন দেখা দেয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেল, কাঁচামাল এবং ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। একই সাথে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাবার কারণে আমদানী ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি অনেকটা কমে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। IMF’ র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গীতা গোপীনাথ গত ২৬ আগস্ট অর্থনীতি নিয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেন, “এবারের মূল্যস্ফীতি সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। তিনি মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হিসেবে অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন।”
অতিমারির কারণে উৎপাদন হ্রাস পেয়ে চাহিদা জনিত সমস্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবার কারণে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। পাশাপাশি জ্বালানী তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহণ ব্যবস্থা এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব দেশের সকল শ্রেণীর জনগণের উপর পড়েছে। তবে, যাদের আয় কম বা সীমিত তারাই মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে।
মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করে থাকে। তার মধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি একটি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মুল উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ হ্রাস করা। সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে থাকে। ব্যাংকের সুদহার বাড়ালে বাজারে চাহিদা কমে, চাহিদা কমলে দাম কমে। ফলে, মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা যায়। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক গত কয়েক মাসে তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশেও নীতি সুদহার ৫ থেকে বাড়িয়ে ৫.৫০ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদ বাড়ালে বা কমালে ব্যাংকের প্রচলিত সুদের হার একই সাথে বাড়ে বা কমে। কিন্তু আমাদের দেশে নীতি সুদহার বাড়লেও ব্যাংকের প্রচলিত সুদহার বৃদ্ধি পায়নি। সুদের সর্বোচ্চ হার এখনো ৯ শতাংশ বিদ্যমান রয়েছে। সুদের হার বাড়ালে বিনিয়োগ কমবে এই প্রত্যয় সুদহার বাড়ানোর পেছনে কাজ করছে।
অন্যদিকে, ভোগ্যপণ্যের চাহিদা জনিত কারণে সম্প্রসারণমূলক নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সম্প্রসারণমূলক নীতিতে বিনিয়োগ যতটুকু বাড়ার কথা ততটুকু নাও হতে পারে। অর্থাৎ সম্প্রসারণমূলক নীতি দ্বারা আয়, উৎপাদন কিংবা বিনিয়োগ বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। যাকে আমরা ‘ক্রাউডিং আউট’ বলি। ঋণ গ্রহীতাদের অনেকেই মনে করেন, মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান কমে যাচ্ছে। তাই, একশ্রেণীর জনগোষ্ঠী ব্যাংকের ঋণ নিয়ে বিলাসদ্রব্য পণ্য কিংবা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করছেন। ঋণের সুদ কম হবার কারণে এমন হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যে ঋণের সুদ হার বাড়ানো হচ্ছে না তা ব্যর্থ হতে পারে। পূর্বের তুলনায় জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আগের মতো অনেকে সঞ্চয় করতে পারছেন না। আমানতকারীদের একটি অংশ আমানত ভেঙ্গে সংসারের বাড়তি ব্যয় সামলে নিতে চেষ্টা করছেন। আবার, ব্যাংকের আমানত সুদ কম হবার কারণে আমানতকারীরা সঞ্চয় ভেঙ্গে শেয়ার বাজারের মতো অনিশ্চয়তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যাচ্ছে। আমানত কমে গেলে বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে। বিনিয়োগ কমে যাওয়া মানে অর্থনীতির ক্ষতি হওয়া।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
করোনার প্রকোপ কমে এলে আমাদের দেশে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। তবে, সে হারে আমানত বাড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্যমতে, ২০২১ সালের জুন মাসে ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৪ শত ৯১ কোটি টাকা যেখানে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৭ শত ৯১ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুন মাসে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ২৪ হাজার ৯ শত ৪২ কোটি টাকা এবং আমানতের পরিমাণ ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে ঋণ বৃদ্ধির হার ১৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং আমানত বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে সেই হারে আমানত বাড়েনি। আমানত কমলে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। তাই, সুদহার কম হলে বিনিয়োগ বাড়বে তা ঠিক নাও হতে পারে।
বাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় উৎপাদনের খরচ, সংস্থার মুনাফা হিসাবের উপর ভিত্তি করে। এটি ‘কস্ট পুশ ইনফ্লেশন’ বা উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি। তাই, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়েও অনেক সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অন্যদিকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাহিদা এবং যোগানের সাপেক্ষে দাম উঠা-নামা করে। তাই সেক্ষেত্রে সুদহার বাড়িয়ে লাগাম টানা যেতে পারে। কিন্তু, এমন কিছু পণ্য আছে যেগুলোর দাম বাড়লে সকল জনগণের উপর এর প্রভাব পড়ে। যেমন জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে পরিবহণ ব্যবস্থাসহ পণ্যের উৎপাদন জনিত খরচ বেড়ে যায়। আবার,সরবরাহ জনিত মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। কারণ, সরবরাহ অবস্থা বিঘ্নিত হবার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। সেক্ষেত্রে সুদহারে লাগাম টেনে কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে না।
অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ফিলিপ্স-এর মতে, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বেকারত্বের বিপরীতমুখী একটি সম্পর্ক রয়েছে। যখন দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে কিংবা ভোগ্যপণ্যের প্রচুর চাহিদা থাকে তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমের চাহিদা বাড়ে। সাথে সাথে মজুরি বাড়বে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। ফলে, বেকারত্ব কমে আসবে। তবে, এই তত্ত্বটি স্বল্প সময়ের জন্য প্রযোজ্য, বৃহৎ পরিসরে এটি কার্যকর নয়। অন্যদিকে, জন টেলরের মতে, মূল্যস্ফীতির সময় সুদের হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কথা বলেছেন। সে অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা তৈরি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা কমানোর জন্য সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। টাকার ছড়াছড়ি কমে যায় বলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে আসে, তবে বিনিয়োগ হ্রাস পায়। তাই সঠিক মুদ্রানীতি প্রণয়নই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যাংকে আমানত সুদের হার মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম হলে গ্রাহক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে সুদের হার মূল্যস্ফীতি থেকে বেশি হলে গ্রাহক লাভবান হবেন। তবে, আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছেন যারা আমানতের বিপরীতে সুদ উত্তোলন করে সংসার চালান। তাদের মধ্যে রয়েছেন সমাজের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত মানুষ, বয়স্ক মানুষ। অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির জন্য ব্যাংকের সুদের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর কারণ হলো, একজন আমানতকারী ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে যে পরিমাণ সুদ পাচ্ছেন তা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে পণ্য ও সেবা কিনতে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। সেজন্যই হয়তো অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুদের হার বেশি থাকা উচিত বলে মনে করেন।
আরও দেখুন:
✓ মূল্যস্ফীতি বনাম ব্যাংক সঞ্চয়
তাই, সুদহার নির্ধারণে উদ্যোক্তার ঋণের চাহিদার পাশাপাশি আমানতকারীর সঞ্চয়ের আকাংখাও গুরুত্বপূর্ণ। করোনার আঘাত অতিক্রম করে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তাই এ মুহূর্তে সুদহার বেড়ে গেলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সেজন্য অনেক অর্থনীতিবিদ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বেলায় সুদহার ৯ শতাংশ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। অপরদিকে, বিলাসপণ্য আমদানী, গাড়ি, বাড়ি, ব্যক্তিগত ঋণসহ বিভিন্ন ভোক্তাঋণের উপর ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে অর্থ ও যোগানের ভারসাম্যের মাধ্যমেই সুদহার নির্ধারণ হতে পারে।
লেখক: অন্জন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট।