মূল্যস্ফীতি বনাম ব্যাংক সঞ্চয়
মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ কোনো নির্দিষ্ট একটি সময়ে, কোনো একটি দেশের পণ্য ও সেবার মূল্যস্তরের সাধারণ বৃদ্ধিকে মূল্যস্ফীতি নামে অভিহিত করা হয়। এইরূপ মূল্যস্ফীতির দরুন কোনো একটি মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। যখন মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। মূল্যস্ফীতির দরুন একই পরিমাণ মুদ্রার বিনিময়ে পূর্বের চেয়ে কম পণ্য পাওয়া যাবে বা একই পরিমাণ পণ্য কিনতে পূর্বের চেয়ে বেশি মুদ্রার প্রয়োজন হবে। বিশ্বের সকল দেশে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে একটি হল মূল্যস্ফীতি।
একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো দেশের মুদ্রার মানের কতটুকু অবমূল্যায়ন হলো তা জানার জন্য মূল্যস্ফীতি ব্যবহার করা হয়। পণ্য ক্রয় বা সেবা ভোগ করতে গিয়ে বিক্রেতা বা সেবা প্রদানকারীকে যে পরিমান অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তাই হলো সেই অর্থের বা মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা। মূল্যস্ফীতির কারণে মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন হয়, ফলে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। এমন পরিস্থিতিতে সমপরিমাণ অর্থের বিনিময়ে পূর্বাপেক্ষা কম পণ্য বা সেবা ক্রয় করা যায়।
বেশির ভাগ মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন আয়–উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। সঞ্চয় তখন হয়ে যায় জীবনযাপনের অবলম্বন। যেহেতু গড় আয়ু বেড়েছে, তাই মূল সঞ্চয় ভেঙে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই সঞ্চয় থেকে যা আয় হয় তার ওপর নির্ভর করেন অনেকে, বিশেষ করে অবসরে যাওয়া লোকগুলো। টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখলে সুদ (ইসলামি ব্যাংক হলে মুনাফা) পাওয়া যায়। তবে সময়ের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বাড়ে বা মুদ্রাস্ফীতি হয়। তাই সুদ বা মুনাফা থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে যা থাকে, তাই সঞ্চয় থেকে আয়। সুদ বা মুনাফার হার বেশি হলে এবং মূল্যস্ফীতি কম হলে সঞ্চয় থেকে আয় বাড়ে। আবার সুদ বা মুনাফার হার কমলে বা মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে সঞ্চয় থেকে আয় কমে। সুদ বা মুনাফার হার থেকে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে সঞ্চয় থেকে আয় না হয়ে বরং তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
আরও দেখুন:
✓ রেমিট্যান্স নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্নতা কেন?
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
চার-পাঁচ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। মে মাসে তা ৭ শতাংশ পেরিয়ে গেল। নিত্যপণ্য চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, জুন মাস শেষে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, গত মে মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এপ্রিল মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে মে মাসে ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, যা এপ্রিল মাসের চেয়ে কিছুটা কম। এপ্রিল মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের কর। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাঁদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা অনেক মানুষের আবার গরিব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে এক বছর মেয়াদি আমানতের সুদের হার ব্যাংকভেদে বিভিন্ন হলেও এর গড় ৫.৫-৭ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ৭.৬ শতাংশ। এ ছাড়া রয়েছে সুদের ওপর ১০ শতাংশ কর ও ব্যাংকে আদায় করা বাহারি নামের বিবিধ ফি। ফলে সামগ্রিকভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে সঞ্চয় থেকে আয় না হয়ে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
আমানতের সুদের হার কম করার পেছনে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব আছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড শ ও রোনাল্ড ম্যাককিনন উন্নয়নশীল দেশসমূহে সরকারের প্রবৃদ্ধিবিরোধী নীতির সমালোচনা করতে গিয়ে এ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। ‘আর্থিক নিষ্পেষণ’ (ফাইন্যান্সিয়াল রিপ্রেশন) নামের এ তত্ত্বের মূল বিবেচনা হলো সরকারের ঋণব্যয় কমানো। যার মাধ্যমে সরকার ব্যক্তি খাত থেকে অত্যন্ত কম সুদে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে। এর ফলে আমানতকারীরা মূল্যস্ফীতি অপেক্ষা কম হারে সুদ লাভ করে। তাই ব্যবস্থাটিকে আর্থিক নিষ্পেষণও বলা হয়ে থাকে।
আর্থিক নিষ্পেষণের কথিত সুবিধার বিপরীতে এর বিরূপ প্রভাব ব্যাপক। প্রথমত, সঞ্চয়কারীদের আয় সংকোচন করার ফলে ঈপ্সিত সঞ্চয় হার হ্রাস পায়। ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগকারীর মধ্যে মধ্যস্থতা ব্যাহত হয় ও বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রাপ্যতা হ্রাস ও এ খাতে স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়। দ্বিতীয়ত, এর ফলে বাজারে ভুল সংকেত যায়। সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল খাতের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল বা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ধাবিত হয়। ফলে গড় উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। তৃতীয়ত, নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্ষুদ্র সুবিধাভোগীদের সহায়তা করার কারণে অপচয় ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে আর্থিক নিষ্পেষণের ফলে ০.৪-.০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। আর্থিক নিষ্পেষণকে কেউ কেউ ‘চোরা কর’ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা এটা ঋণগ্রহীতাকে পুরস্কৃত ও সঞ্চয়কারীদের শাস্তি দিয়ে থাকে। এর ফলে অবসরভোগীরা বিশেষভাবে সঞ্চয়ের আয় থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হন, যার সম্পর্কে আগেই বলেছি।
বাংলাদেশে আর্থিক নিষ্পেষণ নীতি শুরু হয় ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে যখন আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। অনেকে যাকে আর্থিক খাতে ‘নয়–ছয়’ বলে অভিহিত করেছেন। একই সঙ্গে সরকারি সঞ্চয় স্কিমগুলোতেও সুদের হার কমানো হয়। তখন এ যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে। ইতিমধ্যে ২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনা ভাইরাস হানা দেয় এবং ২০২০ সালের জুন মাসে সরকার প্রণোদনা হিসেবে খাতভেদে ৪-৫ শতাংশ ঋণ ছাড় প্রদান করে। এখন দেখা যাচ্ছে যে এসব রেয়াতি ঋণপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের অনেকেই ঋণখেলাপি বা ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ করেছে। এখনো রেয়াতী হারে টাউন পেমেন্ট জমাদান সাপেক্ষে খেলাপী ৠণ পুনঃতফসিল সুবিধা চালু আছে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আর্থিক নিষ্পেষণের প্রধান উদ্দেশ্য যে অত্যন্ত কম সুদে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিল সংগ্রহ, তা একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে। সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য সরকার আট হাজার কোটি টাকার ইজারা সুকুক বন্ড চালু করেছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ বন্ডের ইজারা বাবদ প্রতি ছয় মাসে প্রদেয় হার নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ঘোষিত সরকারের ইসলামিক বিনিয়োগ বন্ডের মুনাফার হারকে ভিত্তি ধরা হয়েছে। ঘোষিত হার ৩.৬৯ শতাংশের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ যোগ করে ইজারার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪.৬৯ শতাংশ (বার্ষিক হার আনুমানিক ৫ শতাংশ), যা মূল্যস্ফীতির হার থেকেও কম। ফলে স্থিরমূল্যে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
মালয়েশিয়ায় সুকুক বন্ড বেশ জনপ্রিয়। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে সেখানে সুকুক বন্ডগুলোর গড় আয় ৩.৫৬ শতাংশ, যেখানে সাধারণ বন্ডের আয় ৩.৩৪ শতাংশ। আপাতদৃষ্টে মনে হবে, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত হার বেশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ২০২০ সালে মালয়েশিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার ০.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা তাদের সঞ্চয় থেকে প্রায় ৩ শতাংশ আয় করবে। আর বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরলে স্থিরমূল্যে ২ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
সার্বিকভাবে আমরা লক্ষ করেছি যে বর্তমানে সঞ্চয়কারীরা মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় স্থিরমূল্যে ৩-৪ শতাংশ আয় করতে পারেন, এমন কোন বিনিয়োগ তাদের হাতে নেই। এর ফলে সঞ্চয়কারীরা ন্যূনতম প্রত্যাশিত আয় না পাওয়ায় পি কে হালদারের পিপলস লিজিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অথবা ব্যাংকে বিনিয়োগ করে সঞ্চয় খোয়াচ্ছেন। সঞ্চয়কারীরা কোনো অপরাধী নন যে তাঁদের এভাবে শাস্তি পেতে হবে! আশাকরি, অন্তত সকল কিছুর সাথে দেশের অর্থবাজারে বিনিয়োগকারী এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থও বিবেচনায় আনা হোক।