বিশেষ কলাম

রেমিট্যান্স নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্নতা কেন?

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ রেমিট্যান্স নিঃসন্দেহে ফরেন কারেন্সীর আমদানীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। বছরের সব মাসেই সমান তালে রেমিট্যান্স আসেনা আবার কোন মাসে কোন বিশেষ উপলক্ষ্য ব্যতীত বড় প্রবাহ ঘটে। এমনটাই রেমিট্যান্সের চরিত্র। সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে বিষয়টা সবাইকে সজাগ করেছে, নীতি নির্ধারকদের কিছুটা উদ্বিগ্নতার কারণও হয়েছে।

তারপরও দীর্ঘদিন ধরে কমতে থাকা প্রবাসী আয়ে এবার বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি।

বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। বাজারে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১০৪/১০৫ টাকা দরেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ২১০ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে প্রতিদিন ৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার করে পাঠিয়েছেন তারা; টাকার হিসাবে প্রতিদিন দেশে এসেছে ৬৪০ কোটি টাকা। গত বছরের জুলাই মাসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

যদিও ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে মন্দা দেখা দেয়। পুরো অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল; গড়ে প্রতিদিন ৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটে ২০২০-২১ অর্থবছরে। সে সময় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। ওই অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটি ৭৯ ডলার প্রবাসী আয় হিসেবে দেশে এসেছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, সাধারণত দুই ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ে; ঈদের পর কমে যায়। তবে এবার কোরবানির ঈদের আগে যে গতিতে রেমিট্যান্স এসেছে, সেই ধারা ঈদের পরেও অব্যাহত আছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সে কারণেই বাড়ছে রেমিট্যান্স।’ এর বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধি অন্যতম। তিনি বলেন, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের কারণে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আশা করছি এখন মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

দেশে গত ১০ জুলাই কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়। ঈদের আগে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঢল নামে। ঈদের ৯০ কোটি ৯৩ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ঈদের পরে ২১ দিনে এসেছে ১১৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের কিছু বেশি।

আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারেও সোমবার প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো এই দরে ডলার কিনেছে। তবে ডলারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যাংকগুলো ১০৪/১০৫ টাকা দরে প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করেছে।

সে হিসাবে কোনো প্রবাসী এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে ১ ডলার দেশে পাঠালে ১০৫ টাকার সঙ্গে নগদ প্রণোদনার ২ টাকা ৫০ পয়সা যুক্ত হয়ে ১০৭টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন।

কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারের ডলারের দরও একই। সে কারণেই প্রবাসীরা এখন অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে দেশে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন বলে জানান ব্যাংকাররা।

দীর্ঘকাল মধ্যপ্রাচ্যে রেমিট্যান্স নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে প্রবাসীদের অনেকগুলো সমস্যা সমাধান করা গেলে আমার বিশ্বাস রেমিট্যান্স মার্কেট আরো শক্তিশালী হবে।

খেলাপি ঋণ রিলেটেড
খেলাপী ৠণ আদায়ে কোন পদক্ষেপই কার্যকর হচ্ছে না

প্রথমতঃ আমরা অনেকেই হুন্ডি হাওয়ালাকে রেমিট্যান্সের প্রতিবন্ধক হিসাবে জানি। এটি অবৈধ জেনেও কেন লোকেরা এই মাধ্যমে টাকা পাঠায়? ব্যাংকগুলো বিদেশী মুদ্রার বিপরীতে যে চাকার বিনিময় মূল্য প্রদান করে তার সাথে হুন্ডির প্রতি কারেন্সীতে তিন চার টাকার তফাত। এখন কে এটা বইবে যেখানে কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে। কিছু কিছু ব্যাংক ভর্তুকী দিয়ে এমন প্রতিযোগীতার মধ্যেও রেমিট্যান্স আনে। অনেক একচেঞ্জ হাউস, জানামতে পাঠানোর খরচও মওকুফ দেয়। তারপরও অফিসিয়ালী রেট যদি কম্পিটেটিভ না করা যায় তাহলে হুন্ডি কমানো শুধু তর্জন গর্জনই হবে।

দ্বিতীয়তঃ ব্যাংকগুলোর সেবাদান প্রবাসী গ্রাহক বা উপকারভোগীর প্রতি এখন মোটামুটি অভিযোগবিহীন। কিছু ব্যাংকে তো ডেডিকেটেড ডেক্সও আছে। তবুও মানুষের প্রত্যাশার তো শেষ নেই। যেখানে হুন্ডির টাকা হোন্ডায় চড়ে বাডী পৌছে দিয়ে মোবাইলে, হোয়াটস অ্যাপে কথা বলিয়ে নিশ্চিত করা হয় তার তুলনায় ব্যাংকের সেবা অপ্রতুল মনেই হবে। ব্যাংকে খুব ভোরে এসে লাইন দেয়, টোকেন, চেক, স্বাক্ষর, নোটিশ সব মিলিয়ে টাকা নিয়ে বের হতে চার পাঁচ ঘন্টা লাগে। নিরাপত্তার বিষয়টি তো আছেই। গ্রাহকদের এটিএম ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে পারলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধানই মিলত।

তৃতীয়তঃ সবাই জানে ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স গ্রাউন্ড অনেক মজবুত। এটাতো একদিনে হয়নি। বিদেশী হাউজগুলোর সাথে ইসলামী ব্যাংকের চুক্তি অনেক লিবারেল, শর্তগুলোও তুলনামূলক সফট। প্রায় আরবদেশেই ইসলামী ব্যাংকের প্রতিনিধি আছে। যারা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে মার্কেটিং ও প্রমোশানের কাজ করে। ১৯৯৫ সালে একাজ আমাকে দিয়ে শুরু হয়, এখনো চল্লিশজনের মত অফিসার তাদের বাইরে আছে। প্রবাসীদের এমন বহু ব্যাংকিংসহ সমস্যা তারা ওখানে বসেই সমাধান করে। অন্য ব্যাংকগুলোও এদিকে নজর দিলে আরো রেমিট্যান্স দেশে আনা যাবে।

চতুর্থতঃ প্রবাসীদের উপকারভোগীর কোন তথ্য ব্যাংকে আছে কি? তাদের পরিবারের খোঁজখবর, সন্তানের লিখাপডা ও কোন রোগী থাকলে তার চিকিৎসায় সহানুভূতি ও সাহায্যে কি ব্যাংক কোন রোল প্লে করে? এগুলো মানুষের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বড় বড় প্যারামিটার। ব্যাংকের অফিসার একাজে এসাইন থাকবে। ব্যাংকের বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাদের দাওয়াত দিবে ও কোন প্রবাসী দেশে আসলে তাকে সংগ দিবে, সম্মান দেখাবে। এগুলো তার মনে থাকবে। আপনি কোনদিন তাকে ভুলে গেলেও সে চিরদিন আপনার কথা স্মরণে রাখবে এবং বিনা পয়সায় আপনার ও ব্যাংকের কথা প্রচার করে বেড়াবে।

পঞ্চমতঃ একথা একবিন্দুও মিথ্যা নয় যে আমাদের এয়ারপোর্টে তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা হয়না, তাদের প্রতি সম্মান দেখানো হয়না বরং ‘যার পরে নাই’ জাতীয় হয়রানির শিকার তাদের হতে হয়। আমি নিজেও এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি। দেশের বিমানে পানি চেয়েও পাওয়া যায়না। মালামালগুলো চরম অযত্ন আর অবহেলায় বিমানবন্দরেই নষ্ট হতে দেখেছি। একদিকে বলা হবে ‘এরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ আর অন্যদিকে চরম অব্যবস্থাপনায় তাদের বিরক্তি উৎপাদন। এর আশু প্রতিকার না হলে বিরুপ পরিস্থিতি হবেই।

শেষতঃ ম্যানপাওয়ার এজেন্টগুলোর প্রতারনা ও জালিয়াতির কারণে প্রবাসীরা আজ অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার। সরকারী নির্ধারিত অংকের বহুগুণ টাকা খরচ করেও এরা আকামা বা স্পন্সরশীপ পায়না। বিদেশে তাদের চাকুরীদাতা কে, কত তার বেতন কিংবা কি তার কাজ কিছুই জানেনা। ফলে গোপনে লুকিয়ে যখন যে কাজ হাতে পায় তাই করে। আমি দেখেছি, অন্য দেশের দূতাবাসগুলো এখানে বেশ তৎপর। চাকুরী তাঁরাই খুঁজে লিগ্যাল বেতনে তারা তাদের লোক দেয়। আমাদের ক্ষেত্রে এর বিপরীত। সরকার বাইরে দক্ষ, অদক্ষ শ্রমিক বা পেশাজীবন যারাই যাবে তার তাবৎ দায়িত্ব নিবেন। এজেন্টদের হাতে এটা চলমান থাকলে বা ব্যবস্থার কোন সংস্কার না হলে প্রবাসীদের কষ্ট কোনদিন দূর হবেনা।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button