বিশেষ কলাম

স্মার্টহাট: এজেন্ট, বিকল্প ব্যাংকিং ও প্রান্তিক অর্থনীতি

মিজানুর রহমানঃ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন হয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে। নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবন মান পরিবর্তন হচ্ছে এবং বদলাচ্ছে তার আকৃতি।

অর্থনীতির দক্ষিণ দুয়ারের পাশেই যেন নব ডানা মেলছে আর প্রস্তুতি নিচ্ছে ডানায় ভরদিয়ে সমিরনে ভেসে মুক্ত নীলিমায় উড়বার। হ্যা এমনটাইতো দেখা। উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের যৌথ উদ্যোগে এবং বাণিজ্যিক ব‍্যাংকের আগ্রহের ভিত্তিতে পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে ঈদ-উল-আযহার পৃথক ৬ টি ব্যাংকের ছয়টি পশুর হাটের নাম ছিল স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট হাট। যেখানে উচ্চবিত্ত থেকে প্রান্তিক পর্যন্ত মিলেছে পরিচয় এবং হয়েছে তাদের রসায়নও।

প্রাসঙ্গিক আলোকপাতে সত্য রুপায়িত হবে যে, প্রযুক্তি নির্ভর উদ্ভাবনী ব‍্যাংকিং ও জ্ঞানভিত্তিক প্রফেশনাল তৈরিতে গুরুত্বারোপ করেন বিভাগীয় প্রধান (ব‍্যাংক এশিয়া, এডিসি) জনাব মোঃ মনিরুজ্জামান খান মহোদয়।

তিনি অন‍্যান‍্য প্রধানগণের সমন্বয়ে “স্মার্ট হাটের” পয়েন্ট অব সেলস, এটিএম ও ডিজিটাল পেমেন্ট বুথের স্থাপনাসহ কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকে নানাবিধ তথ্য ও রিপোর্ট প্রদানে সচেষ্ট ছিলেন। যার কারণে লেখার আগ্রহও অগোচরে অনুপ্রাণিত।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ইতোপূর্বে জানতাম ক‍্যাটেল ট্রেন, ক‍্যাটেল ট্রাক কিংবা ক‍্যাটেল কশাই। এবারই প্রথম দেখেছি স্মার্ট ক‍্যাটেল হাট। যা পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে ডিএনসিসি নির্ধারিত পশুর হাটে যুক্ত করে ডিজিটাল পেমেন্ট বুথ।

সেখানে পশুর মূল্য ও হাসিল পরিশোধ সহ তাৎক্ষণিক হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, এমএফএস সুবিধাসহ প্রযুক্তি নির্ভর একাধিক বিকল্প ব‍্যাংকিং ব‍্যবস্থা ছিল উল্লেখযোগ্য। ক্ষুদ্র পরিসরে এতটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল এই ডিজিটাল পেমেন্ট ব‍্যবস্থা যার অন্তর্ভুক্তি নতুন প্রদীপদানির মতো ভবিষ্যতে ছয়টি হাট থেকে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে ছড়িয়ে দেয়ার দীপ্ত প্রত‍্যয় ব‍্যক্ত করেন সংশ্লিষ্টজনরা।

গত দুইবছরে ডিএনসিসির অনলাইন পশুর হাটের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলোনা। যেমন শারমিন সুলতানা এনী, পরমাণু শক্তি কমিশনের পরীক্ষণ কর্মকর্তা ও আমার অর্ধাঙ্গিনী, তার অনলাইনে খাসি কেনার অভিজ্ঞতা ছিল পীড়াদায়ক।

প্রতিবেশী একজন খাসির পরিবর্তে বকরি ডেলিভারি পেয়েছিল। এছাড়াও প্রান্তিক পশু ব‍্যাপারীদের আর্থিক নিরাপত্তা ও অব‍্যবস্থাপনা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের প্রধান উদ্যোগ ছিল যুক্তিযুক্ত। মুলতঃ ঈদ- উল-আযহার পশুর হাট কে কেন্দ্র করে ডিজিটাল লেনদেন কে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব‍্যাংকের উপযোগী সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ক্রেতা বিক্রেতাদের বিপুল আগ্রহ যেন অর্থনীতির নতুন মেঠোপথ খুঁজে পেয়েছে।

স্মার্ট হাট নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণে নানাবিধ সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে ব‍্যাংক এশিয়ার কর্মকর্তা, পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব‍্যাংক গঠন ও পার্টনারশিপসহ ব্যতিক্রমধর্মী প্রজেক্ট এর কাজে নিমগ্ন এসভিপি, জনাব জাকিরুল ইসলাম মহোদায় ব‍্যাক্ত করেন যে, প্রধান উদ্যোক্তা যেহেতু বাংলাদেশ ব‍্যাংক এবং ক্রেতা ও বিক্রেতাকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে অন্তর্ভুক্তির কারনেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের মতো শাখা বিহীন পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব‍্যাংক গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও চলমান কার্যত বাস্তবায়ন করতে কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহজতর হবে।

উল্লেখ্য গত জুন ২৯, ২০২২ তারিখে রাজধানীর একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মার্ট হাটের আত্মপ্রকাশ করেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী, ডিএনসিসি মেয়র, বাংলাদেশ ব‍্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহ একাধিক বাণিজ্যিক ব‍্যাংকের প্রধান নির্বাহী মহোদয়গণ ও সিনিয়র ম‍্যানেজমেণ্ট উপস্থিত ছিলেন।

প্রচারহীণ ছয়টি গরুর হাট ছিল গাবতলি, মোহাম্মদপুর এর বছিলা, আফতাবনগর, ভাটারা, কাওলা ও উত্তরা মডেল টাউনের সেক্টর -১৭। পেমেন্ট বুথগুলি জুলাই ০১ থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত খোলা থাকার প্রস্তুতি ছিল।

তবে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ৭ জুলাই থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের তথ্য অনুযায়ী স্মার্ট পশুর হাটে ডিজিটাল ব‍্যাংকিং এর মাধ্যমে ৩৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। যা তাদের দৃষ্টিতে সন্তোষজনক মনে হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০২২ এর ঈদ-উল- আযহা উপলক্ষে কোরবানির জবাইকৃত সর্বমোট পশুর সংখ্যা ছিল ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭ শত ৬৩ টি। আর সারাদেশে এই বাজারের মূল্য ও আকৃতি ছিল ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ সেক্টরে ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকের স্বাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টান্ত ইতিবাচক।

মিঃ দুলাল হোসেন, প্রান্তিক গরুর ব‍্যাপারী, ২৩ টি দেশীয় ষাঁড় গরু বিক্রির জন্য ভাটারা পশুর হাটে এসেছিলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আস্তানগর গ্রাম থেকে। গরুর দাম ভালো পেয়েছে, কিন্তু চিন্তা ছিল ক্যাশ টাকা সাথে নিয়ে, হাটে হরেক রকম মানুষের ভীরে কোমরে বাধা গামছায় মোড়ানো ১৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিরাপদ মনে করেনি। ঠিক তখনই ভাটারা গরুর হাটের ইজারাদারের মাইকিং শুনতে পায় “স্মার্ট বাংলাদেশ স্মার্ট হাট। মূল্য পরিশোধ করুন ডিজিটাল বুথের মাধ্যমে এবং নিরাপদে থাকুন।

এভাবেই সন্ধ্যান পান ব‍্যাংক এশিয়ার ডিজিটাল পেমেন্ট বুথের। তার কোন হিসাব নম্বর ছিলনা, তাৎক্ষণিক এজেন্ট ব‍্যাংকিং হিসাব খুলে পর্যায়ক্রমে দুইদিনে গরু বিক্রি করে মোট ২৯ লাখ টাকা জমা দিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত ব‍্যাপারী দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরেন। স্মার্ট হাটের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় ডিজিটাল বুথে দায়িত্বে নিয়োজিত ব‍্যাংক এশিয়ার এডিসি বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জনাব মোঃ সামিউল কায়সার সাহেব এমনটাই শেয়ার করেন।

এ কেবল একটি হাটের একজন গরু ব‍্যবসায়ীর বাস্তব ঘটনা যা গল্প নয় সত্যি। এমনটাই প্রতিটি গরুর হাটের অসংখ্য ব‍্যাপারী ভালো মুনাফার আনন্দের সাথে নগদ ক‍্যাশ বহনে অতীতের ন‍্যায় উদ্বিগ্ন ছিল। যার সমাধানের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের ডিজিটাল হাট ও বিকল্প পেমেন্ট বুথ।

পরীক্ষামূলক ছয়টি পশুর হাটের মধ্যে কোনো রকম চার্জ ছাড়াই প্রান্তিক ব‍্যবসায়ীদের তাৎক্ষণিক হিসাব খোলা ও লেনদেনের তুরুপের তাস ছিল এজেন্ট ব‍্যাংকিং। এর মাধ্যমে সর্বমোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

এটিএম এ লেনদেন হয় ১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, এমএফএস এর মাধ্যমেও লেনদেন হয়েছে মোট ২ কোটি ২২ লাখ টাকা। তবে তা বেশীরভাগ লেনদেন ছিল হাসিল পরিশোধ, পশু ক্রয়ে নয়।

সুবিধা বঞ্চিত মানুষের ব‍্যাংক লেনদেন, প্রান্তিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তি এবং জাতীয় অর্থনীতি কে বেগবান করতে গ্রামগঞ্জের হাট বাজার ও শহর বন্দরে ছড়িয়ে আছে এই সহজ লভ্য এজেন্ট ব‍্যাংকিং, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, মাইক্রো মার্চেন্ট ও ডিজিটাল পোস্ট ব‍্যাংকিং।

এই ব‍্যাংকিং এর নির্মাতা ও মহানায়ক হলেন ব‍্যাংক এশিয়ার স্মপ্নদর্শী প্রেসিডেন্ট ও ব‍্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মো: আরফান আলী মহোদয়। এ ব‍্যাংকিং এর মাধ্যমে হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছ।

শুধু এজেন্ট ব‍্যাংকিংই নয়, সততা ও দক্ষতার সাথে সহস্র কর্মী ও উদ্যোগতাদের হৃদয়ের স্ফুরন হয়ে আমুল পরিবর্তন করেছেন মুল ব‍্যাংকিং ধারাকে। তারই ধারাবাহিকতায় আর্থিক প্রতিষ্টানের মধ্যে ব‍্যাংক এশিয়ার হয়ে তিনিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব‍্যাংক গঠনের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন যা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের ৫০ টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের মধ্যে ৪১ তম। চলমান মুদ্রাস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক সংকট, আভ্যন্তরীণ সমস্যা ও নানাবিধ প্রশ্ন আর প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে।

যদিও আমদানি ব‍্যয় বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মন্দার প্রভাবে জ্বালানি সংকটে নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে, যত সমস্যাই আশুক না কেন, টেকশই গ্রামীণ অর্থনীতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব‍্যবসায়ীদের সঠিকভাবে পরিচর্যার মধ্য দিয়েই সমস্যার সঠিক সমাধান খুঁজে পাবে এবং তারই পথ দেখানো নতুন পথেই ঘুরে দাড়াবে আগামীর বাংলাদেশ, এ ক্ষেত্রে ডেভিড মালপাস এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য: আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতে দরকার ডিজিটালাইজেশনে বাড়তি সমর্থন।

লেখক: মিজানুর রহমান, ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button