খেলাপী ৠণ আদায়ে কোন পদক্ষেপই কার্যকর হচ্ছে না
মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ একটা সময় ছিল যখন ব্যাংকে টাকা আমানত হিসেবে রাখলে মাত্র ছয় বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে যেত। কিন্তু আমানতকারীদের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ঋণ খেলাপিরা। ফলে মাত্র ১২ বছরেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। আর যদি অবলোপন করা ঋণ ধরা হয়, তাহলে তা দেড় লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি চলে যাবে। এখন পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটাকে গোপন খেলাপি ঋণ বলা যায়।
অবশ্য গোপন খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। এ নিয়ে ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশেষ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সেখানে সংস্থাটি বলেছিল, ‘বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। প্রভাবশালী, ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ আছে এবং ধনী, এমন কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। এমনকি বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন নিচ্ছেন প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান এসব ঋণ গ্রাহকেরা।’
আয়কর রিলেটেড
✓ আয়কর ব্যবস্থার ফাঁক ফোকর নিয়ে কি আয়কর বিভাগ ভাবে না?
বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিশ্লেষণ করে আইএমএফ আরও বলেছিল, ‘এখানে খেলাপি আড়াল করে রাখা আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি দুর্বল, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও পান না তাঁরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় এবং বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে।’ (প্রথম আলো ২৪ নভেম্বর ২০২১)
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই ৠণ নানা কারণে খেলাপী হয়, আবার তা নিয়মিতকরনও করা হয়। ৠণ নিয়মিতকরনের নাম রিসিডিউল বা রিস্ট্রাকচারিং। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, ৠণ আদায় সহজ করা এবং ৠণগ্রহীতার উপর চাপ কমিয়ে ধীরে ধীরে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সাহায্য করা। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়ে সময়ে এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং ব্যাংকগুলোকে গাইড করে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীগণের পক্ষেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করা হয়।
করোনা পরবর্তী ধকল সয়ে নিতে ইতোমধ্যে একাধিকবার সময় দিয়েও বকেয়া ৠণের খুব অল্পই আদায় হয়েছে। এরপরও চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিলের বিষয়ে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব দিলে তা পর্যালোচনা করবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থা এফবিসিসিআই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গত ৩১ মে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিলের বিষয়টি পুনর্বহালের দাবি জানান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা অসুবিধার কারণে এই দাবি করা হয়েছে।
পত্রিকায় দেখেছি, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি ব্যাংকের দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে তারা ব্যবসায়িকদের আরও কিছুদিন ঋণ শিথিলের সুবিধা উপভোগ করতে দেবে। তারা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ ব্যাংক এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। তার কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও এই ধরনের পদক্ষেপ নিলে ব্যাংকগুলোতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। যারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালে ঋণগ্রহীতাদের স্থগিত সুবিধা দিয়েছিল। এরপর ২০২১ সালে প্রদেয় তাদের মোট কিস্তির ২৫ শতাংশ পরিশোধ করে ডিফল্ট জোন এড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আগের তিন মাসের তুলনায় ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, এই বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১৩, ৪৪১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং তিন মাস আগের তুলনায় ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ঋণ পরিশোধে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কিছু ব্যবসায়ী খেলাপি হয়েছেন, এছাড়া নীতিগত কিছু ছাড় দেওয়ার কারণেও বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, দেশে খেলাপি ঋণের যে দুষ্ট চক্রের সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর একদিকে যেমন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তেমনি অন্যদিকে দেশের মানুষ নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন যে বিশাল পরিমাণ ঋণের অর্থ খেলাপি হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে তা যদি সঠিক সময়ে ঋণ গ্রহীতারা ফেরত দিতেন তবে ব্যাংকগুলো সেই টাকা অন্য বিনিয়োগ কারিকে দিতে পারত যার ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতে পারত এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও এগিয়ে যেত।
এছাড়া খেলাপি ঋণের একটা অংশ প্রতিবছর মানুষের কাছ থেকে আহরণ করা করের টাকায় মৌকুফ করা হচ্ছে যার ফলে এই টাকাটা দেশের সার্বিক উন্নয়নে খরচ করা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞরা বলেন, খেলাপি ঋণের এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। ৠণ প্রদানে প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত, চলমান ৠণের সামগ্রিক ও নিবিড় তত্বাবধান এবং আদায়ে কঠোর নীতি ব্যাংকগুলোকে এর থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে। একই সাথে ৠণ আদায়ে মামলা মোকদ্দমা ত্বরিত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ট্রাইবুনালও গঠন করা যেতে পারে। খেলাপি ঋণ সহ দেশের ব্যাংকিং খাতে যেসকল অব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পেতে যথাযথ এবং টেকসই সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এটা করা সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতিতে যে অপসংস্কৃতি চলছে তাকে সুপথে আনা সম্ভব হবে।