এসডিজি অর্জনে ইসলামী সোস্যাল ফাইন্যান্স
নূরুল ইসলাম খলিফাঃ সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট এর উদ্যোগে আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিল রামাদানের পূর্বক্ষনে গেল মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখে। Role of Islamic Social Finance in Achieving SDGs অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে ইসলামের সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব ড. আবদুল মজিদ। অনুষ্ঠানটি মডারেট করেছিলেন সরকারের সাবেক আর এক সচিব এবং ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব ড. আরাস্তু খান। হাইব্রিড ধরনের এ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালী অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর জনাব ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রেখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলীনস বিশ্ববিদ্যালয়র অধ্যাপক, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ জনাব ড. কবীর হাসান, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব লেখক ও গবেষক ড. মানজুর এ এলাহী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক জনাব আবদুল আউয়াল সরকার এবং আমার দু’জন সাবেক সহকর্মী ইসলামী ব্যাংক ট্রেনিং এ্যান্ড রিসার্চ একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক জনাব ড. মাহমুদ আহমদ এবং ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব ড. মিজানুর রহমান। সিজেডএম এর নির্বাহী পরিচালক, সরকারের সাবেক সচিব জনাব ড. আইউব মিয়ার সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে আরও বেশ কিছু বিজ্ঞজন উপস্থিত ছিলেন।
এতজন গুনী মানুষের সাথে এ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে আমারও ভাল লাগছিল যদিও অনুষ্ঠানে আমি কোনো বক্তব্য উপস্থাপনা করিনি। সময় ছিল অনেক কম, মডারেটর সাহেব তাড়াহুড়া করছিলেন এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সভা শেষ করার একটা ব্যস্ততা ছিল। আমি স্বভাবতই বলার চেয়ে শুনতে পসন্দ করি বেশি; তদুপরি হাত তুলে বক্তাদের তালিকায় সংযুক্ত হতে কখনও ভালবাসি না। তাই পরবর্তীতে আয়োজকদের অনুরোধে আমার মন্তব্যটুকুন লিখিত আকারে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
প্রবন্ধটির আলোকে কয়েকটি কথা শেয়ার করতে চাই ভার্চুয়াল অঙ্গনের বন্ধুদের সাথে। ইসলামের সামাজিক অর্থায়ন বা ইসলামী সোস্যাল ফাইন্যান্স বলতে সাধারণত যাকাত, ওয়াকফ, সাদাকা, ইনফাক, কাফফারা ইত্যাদিকে বুঝায়। প্রবন্ধটিতে তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে যাকাত, ওয়াকফ এবং ইনফাক বা কল্যাণমূলক ব্যয়। আমরা জানি যে, ২০০০ সালে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আট দফা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে যেখানে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, লিঙ্গ বৈষম্য ও নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যু হ্রাস করা ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল যা ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জন করার লক্ষ ছিল এবং এটাকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা বা এমডিজি (Millennium Development Goals) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব সেখান থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল এবং অবশেষে ২০১৫ সালে মোট সতের দফা উন্নয়ন লক্ষমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত,পরিবেশ বান্ধব এবং মানবিক বিশ্ব গড়ার লক্ষে যার নাম দেয়া হয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা বা এসডিজি (Sustainable Development Goals) এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসব লক্ষমাত্রা অর্জন করার চেষ্টা করা হবে। এমডিজির আট দফারই একটি বর্ধিত রূপ এই সতের দফা এসডিজি।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
কী নোট পেপার এবং এর উপরে উপস্থিত গুনীজনের আলোচনার আলোকে আমার নিজস্ব অনুভূতি নিম্নরূপ-
প্রবন্ধটি নিসন্দেহে বেশ সমৃদ্ধ। এখানে উমর ইবনে আবদুল আজীজের সময়কালের কথা যেমন এসেছে যে, একটি জনপদে দারিদ্র বিমোচন কোন পর্যায়ে গেলে সেখানে যাকাত নেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। তেমনি সম্প্রতিক কালের ইন্দোনেশিয়ার কথাও এসেছে যেখানে যাকাত জিডিপির ৩.৪ শতাংশ কন্ট্রিবিউট করছে। বলা হয়েছে, শুধুমাত্র যাকাতই এসডিজির সতেরটি লক্ষমাত্রার মধ্যে এগারোটি লক্ষমাত্রা অর্জন করতে পারে। (“Zakat could realize around 11 out of 17 goals of SDGs. The target goals are –reducing poverty, hunger, unemployment, inequality, promoting peaceful and inclusive societies, ensuring healthy lives, promoting well-being and preventing the environment from degradation.”)
এসডিজি প্রণীত হয়েছে ২০১৫ সালে, যদি এমডিজিকেও মূল ধরা হয় তাহলে বড়জোর ২০০০ সাল থেকে আমাদের রাষ্ট্রনেতা, চিন্তাবিদ বা সমাজবিজ্ঞানীদের মাথায় এসেছে। অথচ ইসলাম দেড় হাজার বছর আগেই এমন কিছু বিধান ও মেকানিজমের কথা বলেছে যা অধিকাংশ এসডিজি লক্ষমাত্রা পূরণে সহায়ক। সুতরাং ইসলাম যে ব্যাকডেটেড নয় বরং সর্বাধুনিক এটি স্বীকার করতে বোধ হয় লজ্জা পাওয়া উচিৎ নয়। ইসলাম শুধু যাকাতের কথাই বলেনি, সম্পদ উৎপাদন, বন্টন, ভোগ ও ব্যবহার, অর্থনৈতিক লেনদেন এবং ব্যবসা-বানিজ্য ইত্যাদি সকল দিকেই রয়েছে ইসলামের অত্যন্ত কল্যাণধর্মী ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধিমালা। তাহলে, শুধুমাত্র যাকাতের মাধ্যমেই যদি সতের দফার এগারো দফা পূরণ হয়ে যেতে পারে, ইসলামের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিধানাবলী রাষ্ট্র ও সমাজে প্রয়োগ করা গেলে শুধু সতের দফা নয়, আরও কয়েক হাজার বছর পরেও মানব সমাজে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে সেগুলোরও সমাধান এখানে পাওয়া যাবে।
প্রবন্ধটিতে গ্লোবাল পভার্টি গ্যাপ বলা হয়েছে ৫৩১.৯ বিলিয়ন ডলার; আর বিশ্বে হত দরিদ্রের সংখ্যা ৭৬৭ মিলিয়ন যারা দিনে ১.৯ ডলার আয় করতে পারে না। অপরদিকে মাত্র আটজন ধনী লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভুত হয়ে আছে ৪২৬.২ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ছিয়াত্তর কোটি মানুষের দারিদ্র বিমোচনের জন্য যে সম্পদের দরকার, তার কাছাকাছি সম্পদ মাত্র আটজন মানুষের কাছেই রয়েছে। “It means that poverty gap is $531.9 billion per year. Comparing the wealth owned by only the richest eight persons ($426.2 billion) and the total global poverty gap funding requirement ($531.9 billion).”
ইসলামী অনুশাসন বা বিধানের দুটো দিক আছে ইতিবাচক ও নেতিবচাক। অর্থাৎ কিছু কাজ করার সাথে সাথে কিছু কাজকে বর্জন করতে হবে। তাহলেই এখান থেকে কাঙ্খিত ফল আসে। সম্পদ কেন্দ্রিভুত করার বিরুদ্ধে ইসলাম সতর্ক করেছে দেড় হাজার বছর আগেই। সুদ, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, মজুদদারী, ঘুষ– এককথায় সম্পদ পুঞ্জিভুত হবার কারনগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে বহু আগেই। এখন সেই নিষিদ্ধ বিষয়গুলো চালু রেখে শুধু যাকাত থেকে কাঙ্খিত ফল কিভাবে পাওয়া যাবে? রোগের প্রিভেন্টিভ মেজার না নিয়ে শুধু অসুধ দিলে যথাযথ ফল পাওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং এই দুষ্কর্মের বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে, রাষ্ট্র ও সমাজকে এই সমস্ত উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ, পন্ডিত ও সমাজবিজ্ঞানীদের সুদের অকল্পনীয় কুফলকে যুক্তি, বুদ্ধি ও পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষের সামনে আনতে হবে, সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ইসলামী পন্ডিত ও আলেমদের মুনাফাখোরী, মজুদদারী, কালোবাজারী ইত্যাদি অনৈতিক ও অপরাধমূলক বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে হবে, কথা বলতে হবে। তারা শুধু একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজি করবেন, মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করবেন এটি তাদের কাজ নয়। এর মাধ্যমে মূলত সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করা হয় এবং গড়ার চেয়ে ভাঙার কাজ বেশি হয়।
প্রবন্ধটিতে ওয়াকফ এবং ইনফাকের কথাও বেশ সুন্দর ভাবে এসেছে। আমরা জানি বাংলায় মুসলিম শাসনামলে সাধারণ মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজে ওয়াকফের একটি বিশাল ভূমিকা ছিল এবং সেখানে ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। কিন্তু কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে সেই ওয়াকফকৃত সম্পদ বা লাখেরাজ সম্পত্তি জমিদারদের হাতে তুলে দিয়ে দরিদ্র মানুষের পিঠে ছুরি মেরেছেন। আজকে ওয়াকফ আন্দোলনকে বেগবান করা সময়ের দাবী। রাষ্ট্র ও সমাজের বিত্তবান মানুষের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি জনকল্যাণের একটি শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হবে যা সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠনে অভাবনীয় অবদান রাখতে পারে।
আফসোসের কথা হচ্ছে, ইসলামের মত একটি সার্বজনীন কল্যাণকর জীবন ব্যবস্থা আমাদের পন্ডিত, সমাজবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবিদের কাছে অচেনাই থেকে গেল। অথচ তারা ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি ব্যবস্থার পিছনে কত পড়াশুনা এবং গবেষনা করলেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের ক্রুসেডিয় চিন্তার জালে জড়িয়ে পড়ে তারা ইসলামের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হলেন নিদারুন ভাবে! ইসলাম মধ্যযুগীয়, পশ্চাদপদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল এমনি নানা অভিধায়ে ইসলামকে অভিযুক্ত করলেন; কিন্তু বাস্তবে ইসলাম সম্পর্কে চরম অজ্ঞই থেকে গেলেন।
আরও দেখুন:
◾ দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আসুন ইসলাম সম্পর্কে জানুন, বিবেক দিয়ে বিচার করুন এবং তুলনামূলক অধ্যয়ন করতে চেষ্টা করুন দেখবেন আপনার সামনে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে যা দেখে আপনি নিজেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাবেন!
লেখকঃ নূরুল ইসলাম খলিফা, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সাবেক প্রিন্সিপাল, ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।