ব্যক্তিগত ঋণ আপনাকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে না তো!
সাইফুল হোসেনঃ ঋণ যেমন হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়েছে, তেমনি এর সঠিক ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার করে অনেকে অনেক ধনী হয়েছেন, জীবনে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছেন।
আধুনিক বাজার অর্থনীতিতে ‘ঋণ’ একটি খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয় শব্দ। ঋণ ছাড়া যেন কারও একটা দিনও অতিবাহিত হওয়ার উপায় নেই! ঋণমুক্ত জীবন আজকের পৃথিবীতে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবাই যেন ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ (যদিও আমাদের দেশের তুলনায় এই কথা পাশ্চাত্যের জন্য বেশি প্রযোজ্য)।
এই ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন; তবে একে সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে, বিপদ না হয়ে ভালো ফলদায়কও হতে পারে। ঋণ যেমন হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়েছে, তেমনি এর সঠিক ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার করে অনেকে অনেক ধনী হয়েছেন, জীবনে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছেন। এখন তো ঋণ ছাড়া ব্যবসায়ীরা বেশি দূর এগোতে পারেন না।
একটি অভিজ্ঞতা বলি। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোককে জানি, যিনি ভালো একজন চাকুরে, লাখ টাকার উপর বেতন পান। নামকরা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি। তার এক দুলাভাই ব্যবসা করেন; আয় রোজগার ভালো। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তার কিছু টাকার দরকার। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চেয়ে পাননি, তাই আমার পরিচিত ভদ্রলোকটির শরণাপন্ন হন ধারের জন্য।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
যেহেতু তারা পরস্পর আত্মীয়, দুজন আলাপ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। শ্যালক ব্যাংক থেকে পারসোনাল লোন বা ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে দুলাভাইকে দিলেন। টাকার পরিমাণ দশ লক্ষ।
পাঁচ বছর মেয়াদী ঋণ নিয়েছেন শ্যালক, দিয়েছেন দুলাভাইকে। হিসাব খুব লাভজনক। শ্যালক ব্যাংকে মাসিক ইনস্টলমেন্ট দিবেন ২৩ হাজার টাকা, আর দুলাভাই তাকে মাসে দিবেন ৩৩ হাজার টাকা (অনুমিত)। অনেক লাভ। পাঁচ বছরে শ্যালকের টাকা শোধ হয়ে যাবে। তারপর লাভ থাকবে প্রতি মাসে ১০ হাজার, মানে বছরে ১ লক্ষ ২০ হাজার- যা পাঁচ বছরে হবে ৬ লক্ষ টাকা।
দুলাভাই উপকৃত হলেন; ব্যবসা বাড়ালেন। শ্যালক ভাবলেন, দুলাভাই হচ্ছেন আপন বোনের স্বামী, এটুকু না করলে কি হয়! যাহোক, কয়েক মাস খুব ভালো চলল। শ্যালক খুশি; দুলাভাইও খুশি। দুজন মাঝে মধ্যে খুব আনন্দ আড্ডা দেন।
শ্যালক ভাবেন, এই ঋণ শোধ হয়ে গেলে আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দুলাভাইকে দেবেন। দুলাভাই বড় হবেন, শ্যালকও উপকৃত হবেন। শ্যালকের হাত খরচ এখন একটু বেড়েছে; দামি সিগারেট খান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাতে খরচ করেন, বাসার জন্য ভালো বাজার করেন।
দিন ভালোই যাচ্ছিল। দুলাভাই খুব সৎ মানুষ। কখনো কারও কিছু আত্মসাৎ করার মতো মানুষ তিনি নন। তিনি চীন থেকে মোবাইল অ্যাক্সেসরিজ আমদানি করে দেশি বাজারে পাইকারি বিক্রি করেন। হঠাৎ একটা শিপমেন্টে তার মালামাল খারাপ আসে। তিনি সেগুলো বাজারে বিক্রি করতে ব্যর্থ হন। মাল অবিক্রিত থেকে যায়। শ্যালকের টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব হতে থাকে। এক পর্যায়ে দুলাভাই টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন।
ওদিকে, শ্যালক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য। এক বছর পর থেকেই শ্যালককে ব্যাংকের টাকা শোধ করতে হয়েছে। দুজনের সম্পর্কে অবনতি ঘটে। পাঠক, বুঝতেই পারছেন, দুলাভাই অন্যায় কিছু না করলেও শ্যালককে দুর্গতি ভোগ করতে হয়েছে। আর দুলাভাই যদি অসৎ হতেন, তাহলে আরও কত সমস্যা হতে পারত। শ্যালককে ব্যক্তিগত ঋণ তার বেতন থেকে পরিশোধ করতে হবে।
প্রসঙ্গ হচ্ছে ঋণ। ঋণকে বর্তমান সমাজে খারাপ কিছু বলা যাবে না। কারণ, ঋণ না পেলে অনেকেই আজ পিছিয়ে থাকতেন। এখন বলা হয়, ঋণপ্রাপ্তি সবার অধিকার হওয়া উচিত। তবে ঋণ নিয়ে যারা ঘি খান, বিলাসী জীবনযাপন করেন, ঋণ নিয়ে যারা টাকা বৃদ্ধির কাজে না লাগিয়ে খরচ করেন ভোগের পেছনে, তাদের জন্য মাঝে মধ্যে ঋণ সর্বশান্ত হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
উল্লেখিত শ্যালক যদি চাকরি না করতেন বা চাকরি যেকোনো কারণে হারিয়ে ফেলতেন, তাহলে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা তার জন্য অতি যন্ত্রণার বিষয় হয়ে যেত। আমার আলোচনার অবতারণা হচ্ছে ঋণ বিষয়ে সতর্ক করার জন্য; ঋণ নেওয়া বা না নেওয়ার জন্য নয়। কারণ, সেটা আপনার বিবেচনা। আমরা জানি, আজকের দুনিয়ায় ঋণপ্রাপ্তি বড় কথা নয়; বরং বড় কথা হচ্ছে প্রাপ্ত ঋণ কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সেটা।
ভালো ঋণ, মন্দ ঋণ
ঋণের আবার ভালো-মন্দ কী- এই প্রশ্ন আসাটা খুব স্বাভাবিক। ঋণের রঙ, রূপ- সব একইরকম। ঋণ মানেই সেটার সুদ থাকবে- একটু কম বা একটু বেশি। তাই ঋণের ভালো-মন্দ শ্রেণিবিন্যাস সেই ঋণের ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। ঋণ নিয়ে যদি আপনি সরাসরি ভোগ করেন; অর্থাৎ খাবার কেনেন, বিলাসদ্রব্য কেনেন, বাড়ি-গাড়ির সাজসজ্জার জন্য ব্যয় করেন, ঘোরাঘুরির পেছনে ব্যয় করেন- তবে সেই ঋণ আপনার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। কারণ, যার পেছনে আপনি খরচ করছেন, তা আপনার জন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বয়ে আনছে না; বরং আপনার আর্থিক বোঝাটাকে আরও ভারি করে তুলছে। এই ঋণ আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য মন্দ ঋণ।
অনেকে বলেন, এটা অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করছে, প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কথাটি মিথ্যা নয়। ঋণের প্রবাহ বাড়লে সামগ্রিক অর্থনীতিতে তারল্য প্রবাহ বাড়ে। পশ্চিমা অর্থনীতি চালিত হয় এই ভোগ উসকে দিয়ে। কিন্তু এই তারল্য অর্থনীতিতে ধনাত্মক নাকি ঋণাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করে- তা হিসেব করে বের করা খুব দুরূহ। অবশ্য একজন ব্যক্তির জীবনে যে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে, সেটা প্রমাণিত। আর যখন একজন ব্যক্তি খারাপ থাকেন, তখন সামগ্রিক অর্থে মন্দ ঋণের প্রভাব ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
ধরুন ক্রেডিট কার্ডের কথা। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলাদেশে ১২ লাখেরও বেশি ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক ছিলেন। এখন তা আরও বেড়েছে। ক্রেডিট কার্ড প্রথমে বেশ কিছুটা স্বস্তি হয়তো মানুষকে দেয়; কারণ, ক্রেডিট কার্ড হাতে থাকলে বাজার করতে খুব ভালো লাগে, খরচ বাড়ানো যায়, ঋণে অংশগ্রহণ করে ভোগ বাড়ানো যায়। কিন্তু পরিশোধ করার সময় প্রত্যেক কার্ড ব্যবহারকারির খুব কষ্ট হয়।
সবচেয়ে বড় কথা, ক্রেডিট কার্ড খরচের প্রবণতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়োজনীয়তাকে বাড়িয়ে দেয়। খুব অল্পসংখ্যক লোক রয়েছেন, যারা এটাকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারেন। তাই দেখা যায়, অধিকাংশের কাছে এটা একটা খারাপ অভিজ্ঞতা।
অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো ব্যাংক ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করে থাকে। তাছাড়া তাদের রয়েছে নানা ধরনের লুক্কায়িত চার্জ। সত্যি কথা বলতে, কেউ একবার এই কার্ডের গ্যাঁড়াকলে পড়লে নিজেকে সহজে মুক্ত করতে পারেন না। ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছেন- এমন লোক আছেন; তবে তাদের সংখ্যা খুব কম। তাই এটি ভালো ঋণের আওতায় পড়ে না।
কথায় আছে, ঋণ আবার ভালো হয় কী করে? কথাটি ঠিক। আমরা বলছি যেসমস্ত ঋণ আপনার উপকার করছে, সম্পদ বাড়াতে সহযোগিতা করছে- সেটি ভালো ঋণ। ঋণ ভালো হওয়া মূলত নির্ভর করে তার ব্যবহারের ওপর। যদি কেউ এমনভাবে ঋণকে ব্যবহার করতে পারে, যেন ঋণের টাকা বাড়ে, অর্থাৎ ঋণ সুধসহ পরিশোধ করার পরও যদি হাতে কিছু অতিরিক্ত টাকা থাকে, তাহলে সেটা খারাপ নয়। তাই ঋণ নিয়ে যদি কেউ সম্পদ কেনেন, যেটার মূল্য সুদাসলের চেয়ে বেশি হয়, তবে সেই ঋণ মন্দ নয়; বরং ভালো।
বিবিধ রিলেটেড
✓ মৃত ব্যক্তির টাকা কারা পাবেন?
ঋণ নেওয়ার আগে তাই হোমওয়ার্ক করা খুব জরুরি। খাতা-কলমে হিসেব করে তারপর ঋণের দিকে পা বাড়ানো উচিত। আর্থিক ব্যবস্থাপনার জ্ঞান থাকা জরুরি। তবে অনেক সময় মানুষ বিপদে পড়েন অনেক হিসেব-নিকেশ করার পরেও; যেমন পড়েছেন ওই শ্যালক ভদ্রলোক। তাই ঋণ করে সেই ঋণের টাকা নিজের আয়ত্ত্বে রেখে টাকা বা সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় কি না, সেটা ভাবতে হবে। অন্যের ওপর নির্ভর করে যিনি হাত গুটিয়ে বসে থেকেছেন, তিনিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপদে পড়েছেন।
যারা ভোগ করার জন্য বেশি সুদে ঋণ করেন, তাদের বিপদ কেউ ঠেকাতে পারবে না। যারা এ ধরনের ঋণ করেন, তাদের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই ঋণ পরিশোধ করা। তা না হলে ওই ঋণের বোঝা বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে যেতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই হয়। এজন্য ঋণের বিষয়ে খুব সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সব ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, ভোক্তা ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদ চার্জ করলে তাদের খরচ উঠানো কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, এ ধরনের ঋণ ব্যবস্থাপনা খরচ অনেক বেশি।
যারা চাকরিজীবী, তারা তো ব্যবসায়ী নন। সীমিত আয় দিয়ে তাদের চলতে হয়। সেজন্য তাদের ওপর সুদের বোঝা কমানো যায় কীভাবে, সেই চিন্তা সরকারকে করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশে একজন চাকরিজীবীর ওপর অনেকজন নির্ভর করে। ব্যবসায়ীদের ঋণের সুদ কমানোর পাশাপাশি ব্যক্তিগত ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সুদহার কমানো জরুরি।
অন্যদিকে, ঋণ গ্রহণের সময় গ্রহীতাদের সতর্ক হতে হবে। কী উদ্দেশ্যে ঋণ নিচ্ছেন, কেন নিচ্ছেন, কীভাবে শোধ করবেন- তার চুলচেরা হিসেব করুন। ঋণ করে ঘি খাওয়া ভালো কথা নয়। ভেবে দেখুন, আজ যারা ঋণগ্রস্ত, তাদের অবস্থা কত খারাপ!
লেখকঃ কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।