মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও ব্যাংকারদের দায়িত্ব: ২য় পর্ব
মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ মানি লন্ডারিং এর অর্থের উৎস হচ্ছে অপরাধমূলক কার্য। আইনের ভাষায় যাকে (Predicate Offence) সম্পৃক্ত অপরাধ বলে আখ্যায়িত করা হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ ধারা ২ (শ)তে “সম্পৃক্ত অপরাধ (Predicate Offence)” বলতে তাকেই বুঝানো হয়েছে, যা দেশে বা দেশের বাইরে সংঘটনের মাধ্যমে অর্জিত কোন অর্থ বা সম্পদ লন্ডারিং করা বা করার চেষ্টা করা। Predicate offense বা সম্পৃক্ত অপরাধ হলো ২৮টি। অর্থাৎ যে নির্দিষ্ট ২৮টি অপরাধ Money Laundering এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত তাকে predicate offense বা সম্পৃক্ত অপরাধ বলে। Money Laundering সংক্রান্ত Predicate Offence বা সম্পৃক্ত অপরাধগুলি হলো-
(১) দুর্নীতি ও ঘুষ;
(২) মুদ্রা জালকরণ;
(৩) দলিল দস্তাবেজ জালকরন;
(৪) চাঁদাবাজি;
(৫) প্রতারণা;
(৬) জালিয়াতি;
(৭) অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা;
(৮) অবৈধ মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা;
(৯) চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা;
(১০) অপহরণ, অবৈধভাবে আটকাইয়া রাখা ও পণবন্দী করা;
(১১) খুন, মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি;
(১২) নারী ও শিশু পাচার;
(১৩) চোরাকারবার;
(১৪) দেশী ও বিদেশী মুদ্রা পাচার;
(১৫) চুরি বা ডাকাতি বা দস্যুতা বা জলদস্যুতা বা বিমান দস্যুতা;
(১৬) যৌতুক;
(১৭) চোরাচালানী ও শুষ্ক সংক্রান্ত অপরাধ;
(১৮) মানব পাচার বা কোন ব্যক্তিকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মিথ্যা আশ্বাস প্রদান করিয়া কোন অর্থ মূল্যবান দ্রব্য গ্রহণ করা বা করিবার চেষ্টা;
(১৯) কর সংক্রান্ত অপরাধ;
(২০) মেধাস্বত্ব লংঘন;
(২১) সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থ যোগান;
(২২) ভেজাল বা স্বত্ব লংঘন করে পণ্য উৎপাদন;
(২৩) পরিবেশগত অপরাধ;
(২৪) যৌন নিপীড়ন (Sexual Exploitation);
(২৫) পুঁজি বাজার সম্পর্কিত মূল্য সংবেনশীল তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে তাহার কাজে লাগাইয়া শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে বাজার সুবিধা গ্রহণ ও ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার লক্ষ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা (Insider Trading & Market Manipulation);
(২৬) সংঘবদ্ধ অপরাধ (Organized Crime) বা সংঘবদ্ধ অপরাধী দলে অংশগ্রহণ;
(২৭) ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়; এবং
(২৮) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক [বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট] কর্তৃক সরকারের অনুমোদনক্রমে গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষিত অন্য যে কোন সম্পৃক্ত অপরাধ। (বাংলাদেশ গেজেট,১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৯)
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
আইন অনুযায়ী রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা, তাদের মূল দায়িত্ব ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার সাজা-
রিপোর্ট্ং সংস্থার তালিকা-
(১) ব্যাংক;
(২) আর্থিক প্রতিষ্ঠান;
(৩) বীমাকারী;
(৪) মানি চেঞ্জার;
(৫) অর্থ অথবা অর্থমূল্য প্রেরণকারী বা স্থানান্তরকারী যে কোন কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান;
(৬) বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিক্রমে ব্যবসা পরিচালনাকারী অন্য কোন প্রতিষ্ঠান;
(৭) স্টক ডিলার ও স্টক ব্রোকার;
(৮) পোর্টফোলিও ম্যানেজার ও মার্চেন্ট ব্যাংকার;
(৯) সিকিউরিটি কাস্টডিয়ান;
(১০) সম্পদ ব্যবস্থাপক;
(১১) অলাভজনক সংস্থা/প্রতিষ্ঠান (Non Profit Organization);
(১২) বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (Non Government Organization);
(১৩) সমবায় সমিতি;
(১৪) রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার;
(১৫) মূল্যবান ধাতু বা পাথরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান;
(১৬) ট্রাস্ট ও কোম্পানী সেবা প্রদানকারী;
(১৭) আইনজীবী, নোটারী, অন্যান্য আইন পেশাজীবি এবং একাউন্টেন্ট;
(১৮) সরকারের অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক, সময়ে সময়ে, বিজ্ঞপ্তি জারীর মাধ্যমে ঘোষিত অন্য কোন প্রতিষ্ঠান।
রিপোর্টিং সংস্থার দায়িত্ব
(ক) উহার গ্রাহকের হিসাব পরিচালনাকালে গ্রাহকের পরিচিতির সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংরক্ষণ করা;
(খ) কোন গ্রাহকের হিসাব বন্ধ হইলে বন্ধ হইবার তারিখ হইতে অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত উক্ত হিসাব ও হিসাবের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করা;
(গ) সংরক্ষিত তথ্যাদি [বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের] চাহিদা মোতাবেক, সময় সময়, সরবরাহ করা;
(ঘ) কোন সন্দেহজনক লেনদেন বা লেনদেনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হইলে স্ব-উদ্যোগে অবিলম্বে [বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে] ‘সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট’ করা।
কোন রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা এই বিধান লংঘন করিলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ
(ক) উক্ত সংস্থাকে অন্যূন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করিতে পারিবে; এবং আরোপিত জরিমানার অতিরিক্ত উক্ত সংস্থা বা সংস্থার কোন শাখা, সার্ভিস সেন্টার, বুথ বা এজেন্টের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অনুমতি বা লাইসেন্স বাতিল করিতে পারিবে বা ক্ষেত্রমত, নিবন্ধনকারী বা লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে উক্ত সংস্থার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে বিষয়টি অবহিত করিবে।
মানিলন্ডারিং অপরাধ ও দণ্ড
কোন ব্যক্তি মানিলন্ডারিং অপরাধ করিলে বা মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করিলে তিনি অন্যূন
(ক) ৪ (চার) বৎসর এবং অনধিক ১২ (বার) বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং
(খ) ইহার অতিরিক্ত অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুন মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত, যাহা অধিক, অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
তবে শর্ত থাকে যে, আদালত কর্তৃক ধার্যকৃত সময়সীমার মধ্যে অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হইলে আদালত অপরিশোধিত অর্থদণ্ডের পরিমাণ বিবেচনায় অতিরিক্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।
(গ) আদালত কোন অর্থদণ্ড বা দণ্ডের অতিরিক্ত হিসাবে দণ্ডিত ব্যক্তির সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে যাহা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানিলন্ডারিং বা কোন সম্পৃক্ত অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত বা সংশ্লিষ্ট।
আরও দেখুন:
◾ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের কার্যকারিতা ও ব্যাংকারদের দায়িত্ব – প্রথম পর্ব
কোন সত্তা এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করিলে বা অপরাধ সংঘঠনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করিলে অপরাধের সহিত সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্যের অন্যূন দ্বিগুণ অথবা ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা, যাহা অধিক হয়, অর্থদন্ড প্রদান করা যাইবে এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিলযোগ্য হইবে।
তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত সত্তা আদালত কর্তৃক ধার্যকৃত সময়সীমার মধ্যে অর্থদন্ড পরিশোধে ব্যর্থ হইলে আদালত অপরিশোধিত অর্থদন্ডের পরিমাণ বিবেচনায় সত্তার মালিক, চেয়ারম্যান বা পরিচালক যে নামেই অভিহিত করা হউক না কেন, তাহার বিরুদ্ধে কারাদন্ডে দন্ডিত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।
লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।