অর্থনীতি

ডলারের দাম, মুদ্রাস্ফীতি ও অন্যান্য

মো. কামরুজ্জামানঃ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে টাকা ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকার পর গত আগস্ট থেকে হঠাৎ করে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমতে থাকে। বর্তমানে এক আমেরিকান ডলারের বিনিময় হার ৮৫.৮০ টাকা, যা গত জুলাই মাসেও ছিল ৮৪.৮০ টাকা। (এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত বিনিময় হার; আন্তঃব্যাংক তার আরও হার বেশি)। অবস্থাদৃষ্টে ডলারের মানের এই মানের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা OR বাজারে এই মনে হচ্ছে, সহসাই টাকার: থামছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যের এই অবনতি কেন হচ্ছে এবং এতে অর্থনীতির উপরইবা কী প্রভাব পড়বে।

প্রসঙ্গত, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার হার নির্ধারিত হয় চাহিদা ও জোগানের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, যাকে ভাসমান হার বা floating rate বলে। আমাদের দেশে ৩১ মে, ২০০৩ সাল থেকে স্থায়ী হারের (fixed rate) পরিবর্তে পরিবর্তনশীল হার (floating rate) চালু হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এই হার নির্ধারণে সম্পূর্ণভাবে বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে না দিয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এজন্য আমাদের বিনিময় হারকে বলা হয় নিয়ন্ত্রিত ভাসমান হার (Managed floating rate)।

আরও দেখুন:
অর্থ ব্যবস্থাপনার পাঁচ পরামর্শ
নিম্ন সুদহার নীতি আর উচ্চ সুদহার ঝুঁকির চক্রে ব্যাংক

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, সেকশন ৭/এ-তে বাংলাদেশ ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে (ডলারের সরবরাহ বেড়ে গেলে) বা প্রয়োজনে বাজারে ডলার ছেড়ে (ডলারের চাহিদা বেড়ে গেলে) এই হার পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমদানি যখন রপ্তানির তুলনায় বেশি হয়, তখন ডলারের চাহিদা বেড়ে যায় দাম বৃদ্ধির প্রবণতা থাকে। আর উল্টোটা ঘটে, যখন রপ্তানি বেশি হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আমাদের দেশে ট্রেডিং অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স (balance export and import of goods) সব সময় ঋণাত্মক থাকে, তাই টাকার মূল্যহ্রাসের প্রবণতা সবসময় বাজারে লক্ষ্য করা যায়। আর এসব ক্ষেত্রে সাধারণত আমদানিকারকরা বিপদে পড়ে থাকেন। কারণ, ডলারের দাম বেড়ে গেলে আমদানি বিল পরিশোধের জন্য তাদের আগের থেকে বেশি টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয়। তবে বিদেশ থেকে শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স স্বস্তির পর্যায়ে থাকে এবং ডলারের অত্যধিক চাপটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।

বর্তমান সময়ে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, বিদেশের বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়া। বিশেষ করে জ্বালানি তেলসহ পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত আমদানি বিল পরিশোধ করতে গিয়ে ডলারের ওপর চাপ বেড়েছে। এই চাপ এতটাই বেশি, বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকগুলোর কাছে দফায় দফায় ডলার বিক্রি করেও সেই চাপ সামলাতে পারছে না। অতিরিক্ত ডলার বিক্রির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভেও টান পড়েছে।

সর্বশেষ গত আগস্ট, ২০২১ এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল রেকর্ড ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার, যা অক্টোবর শেষে কমে দাঁড়িয়েছিল ৪৬.৪৬ বিলিয়ন ডলার এবং বর্তমানে হয়তো সেটা আরও কমে গিয়ে থাকতে পারে। তবে রিজার্ভ কমলেও চিন্তার তেমন কিছু নেই কারণ, বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে অন্তত ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। একটি দেশের রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের ব্যবস্থা থাকলেই যথেষ্ট বলে ধরে নেওয়া হয়।

এবারে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের হ্রাস বা বৃদ্ধিতে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে তা একটু খতিয়ে দেখা যাক।
প্রথমত, টাকার মূল্য কমলে রপ্তানিকারকরা খুশি হয়, কারণ তারা রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত ডলার বেচে আগের থেকে বেশি টাকা পায়। কিন্তু আমদানিকারকরা এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কারণ আমদানি বিল পরিশোধের জন্য একই পরিমাণ ডলার কিনতে তাদের বেশি টাকা লাগে।

দ্বিতীয়ত, আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে দেশীয় বাজারে তার প্রভাব পড়ে, অর্থাৎ দামস্তর বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটায়। অন্যদিকে রপ্তানিকারকরা ডলার থেকে আগের তুলনায় বেশি টাকা পায় বলে অভ্যন্তরীণ বাজারে মুদ্রা সরবরাহ (money supply) বেড়ে যায়। এর ফলেও মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। বর্তমান সরকারের অনেক সফলতার মাঝে একটি বড় অর্জন বোধ করি প্রায় বিগত এক দশক ধরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছয় শতাংশের মধ্যে ধরে রাখা। গত অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি কোভিড মহামারী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রসারণশীল (expansionary and accomodative) মুদ্রানীতি সত্ত্বেও, মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫৬ শতাংশে রাখতে পারাটা একটা বড় সাফল্য। যদিও বর্তমানে বাজারের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়ছে।

গত ১৫ নভেম্বরে এই হার ছিল ৫.৫৯%। টাকার মানের অবমূল্যায়নের এই ধারা চলতে থাকলে মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। এখানে বলে রাখা দরকার, একটি অর্থনীতিতে প্রধানত তিনটি কারণে মুদ্রাস্ফীতি হয়।
এক. পণ্যের উৎপাদন বা জোগানের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গেলে (demand pull inflation),
দুই. দ্রব্য বা সেবা সামগ্রীর উৎপাদন খরচ বা আমদানি খরচ বেড়ে গেলে (cost-push inflation),
তিন. চাহিদা অপরিবর্তিত থাকলেও কোনো কারণে (যেমন খরা, বন্যা বা যুদ্ধবিগ্রহ) দ্রব্য সামগ্রীর জোগানের ঘাটতি হলে (supply shock inflation)। অবশ্য বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং শ্রমের বিশ্বব্যাপী যাতায়াত অনেকটা সহজ হওয়ায়, মূল্যস্ফীতির পেছনে আরও নতুন নতুন অনুঘটক কাজ করে, যা ব্যষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

বহির্বিশ্বে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে বা শ্রমের মূল্যসহ উৎপাদনের উপকরণের দাম বেড়ে গেলে আমাদের দেশেও তার প্রভাব পড়ে। কোভিড পরবর্তী বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তথ্যমতে, বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতির গড় হার ২০২০ সালে ৩.২ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৫ শতাংশ। এর প্রধান কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সরকারের বড় অংকের প্রণোদনাকে দায়ী করছেন। মানুষের হাতে নগদ টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদার বৃদ্ধি ঘটেছে। এর ফলে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। এর প্রভাব অচিরেই আমাদের অর্থনীতির ওপর যে পড়বে, সেটা ধরে নেওয়া যায়।

তবে মজার ব্যাপার হলো, অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতিকে সব সময় শত্রু মনে করেন না, বরং শত্রু মনে করেন মূল্যসংকোচনকে (deflation), যা মূলত মূল্যস্ফীতির বিপরীত অবস্থা। বলা হয়ে থাকে, আমাদের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য পাঁচ থেকে আট শতাংশ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি থাকা ভালো। এতে উৎপাদন উৎসাহিত হয়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হয়।

মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সুদের হারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে সুদের হারও বাড়াতে হয়। বিশেষ করে যেসব সাধারণ আমানতকারী ব্যাংকে টাকা রাখেন লাভের আশায়, সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে সমন্বয় না করলে তাদের প্রকৃত আয় (real income) কমে যায়। আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক সুদের হারের সীমা (বিশেষ করে ঋণের ক্ষেত্রে) নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। তাই এর ওপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ব্যক্তি শ্রেণির সঞ্চয়ের হার মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে সমন্বয় করে দিয়েছে। তবে ঋণের হারের উচ্চসীমা অপরিবর্তিত থাকায় ব্যাংকের স্প্রেড তথা আয় কমে যাচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির হার যদি বর্তমান অবস্থা থেকে আরও বেড়ে যায়, আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক নির্দেশনা মোতাবেক আমানতের সুদ হারকে তদানুসারে বাড়াতে হয়, তবে ব্যাংকের তহবিল খরচ আরও বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার ওপর বেশ চাপ পড়বে। অন্যদিকে আমানতের সুদ হার মূল্যস্ফীতি হারের কম হলে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে টাকা না রেখে বিভিন্ন রকম অনুৎপাদনশীল খাত তথা ফটকাবাজারির দিকে (যেমন- জমি বেচাকেনা বা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ইত্যাদি) ঝুঁকতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

তাই সরকারের উচিত হবে, ব্যষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য নিয়ামকের (parameters) মতো সুদের হারকে বাজারভিত্তিক করা অর্থাৎ বাজারের নিজস্ব শক্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া। এতে করে আর্থিক খাতে একদিকে যেমন শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, তেমনি সামগ্রিক অর্থনীতিতে ঘটবে গতির সঞ্চার।

মো. কামরুজ্জামান লেখক ও ব্যাংকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button