অর্থনীতিবিশেষ কলাম

গভীর সমুদ্রের সম্ভাবনায় নীল অর্থনীতি

মো. জিল্লুর রহমানঃ বাংলাদেশের যে সমুদ্রসীমা আছে তা মূল ভূখণ্ডের ৮১ ভাগের সমান। অথচ বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত। সীমিত পর্যায়ে কিছু পরিমাণ তেল-গ্যাস এবং মৎস্য সম্পদ আহরণ করা হলেও, তার পরিমাণ বঙ্গোপসাগরের অফুরন্ত সম্পদেও তুলনায় খুবই নগণ্য। এমনকি সমুদ্র সম্পদ সম্পর্কে জরিপ চালানোর উপযোগী আধুনিক জাহাজ পর্যন্ত নেই। সময়ে সময়ে বাপেক্সসহ বিদেশি সহায়তায় যৎসামান্য জরিপ কাজ চালানো হলেও বঙ্গোপসাগরের অমিত ও অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। ২০১২ সালে মিয়ানমার থেকে ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ভারত থেকে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার (টেরিটোরিয়াল সি) অধিকার লাভে সফল হয়। ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অন্যান্য সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার লাভ করে। অথচ এই বিশাল অঞ্চলে কী পরিমাণ মৎস্য ও খনিজ সম্পদ রয়েছে, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই।

নীল অর্থনীতি (ইংরেজিতে ব্লু ইকোনমি) হলো গভীর সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। গভীর সাগরের বিশাল নীল জলরাশি এবং সমুদ্র তলদেশের বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। পৃথিবীর তিনভাগের দুইভাগ পানি এবং এজন্য সমুদ্রকে বলা হয় সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার। তেল, গ্যাস, শৈবাল, ইউরেনিয়াম, জিরকন, শামুক, ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ রয়েছে অফুরন্ত খনিজসম্পদ। সমুদ্রের এসব সম্পদকে আহরণ করে রপ্তানির মাধ্যমে আয় করা সম্ভব মিলিয়ন মিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশের জন্য নীল অর্থনীতি হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় খাত। দেশের স্থলভাগের প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্রসীমায় এখন মূল্যবান সম্পদের ভাণ্ডার।

ভারত ও মিয়ানমার থেকে অর্জিত সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ইজারা দিয়ে এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব।
সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ‘নীল অর্থনীতি : সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় জানানো হয়, বাংলাদেশের যে সমুদ্রসীমা আছে তা মূল ভূখণ্ডের ৮১ ভাগের সমান। পুরো বিশ্বে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে দেড় লাখ জাহাজ চলাচল করে, সেখানে বাংলাদেশের জাহাজ মাত্র ৭০টি। অথচ এই পথে পণ্য পরিবহনের অর্থনীতির আকার ৯০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া কনটেইনার নির্মাণেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে। এশিয়া অঞ্চলে ৭৪ শতাংশ কনটেইনার ব্যবহার হয়। প্রতি বছর ১৫ শতাংশ হারে বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কনটেইনারের চাহিদা আরো বাড়বে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বন্দর থাকলেও, তা মাদার ভেসেলের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। এমন অবস্থায় মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে তা নীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সহায়তা করবে। নীল অর্থনীতি বাংলাদেশে বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনাময় খাত। এ খাত থেকে আগামী কয়েক বছরেই ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করা সম্ভব। এজন্য সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পদ সংরক্ষণের নীতিও গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মোট আয়তন ৬৬৪ কিলোমিটার, কিন্তু মাছ আহরণ করা হয় মাত্র ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে। আর তাই মাছের বৈশ্বিক উৎপাদনে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র দুই দশমিক ছয় শতাংশ। অথচ চীন একাই বিশ্বের ৬১ শতাংশ মাছের জোগান দিচ্ছে। একইভাবে সাগরের সীমানায় মালিকানা প্রতিষ্ঠা হলেও, এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে সমুদ্রবক্ষের বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস। শুধু মাছ কিংবা খনিজসম্পদ নয়, নিজেদের সীমানার সাগরকে ব্যবহার করে পালটে দেওয়া যেতে পারে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতির চিত্র।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এ ছাড়া নীল জলরাশির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিচিত্র সামুদ্রিক সম্পদ। তেল, গ্যাস, মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম, মোনাজাইট, জিরকন, শামুক, ঝিনুক, মাছ, অক্টোপাস, হাঙর ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ রয়েছে নীল সাগরে। সেখানে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ছাড়াও ২০ জাতের কাঁকড়া, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ৩৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুকের সন্ধান পাওয়া গেছে। টুনার মতো দামি ও সুস্বাদু মাছ রয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা প্রচুর।

২০১২ সালের ১৪ মার্চ মাসে মিয়ানমারের সাথে এবং ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। এর পরই নীল অর্থনীতির চূড়ান্ত অর্জনের জন্য কাজ করতে শুরু করে বাংলাদেশ। এরপর জ্বালানি ও খণিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘নীল অর্থনীতি সেল’ গঠন করে সরকার। একইসাথে, ২০১৯ সালে সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট করেছে সরকার। এ ছাড়া, ২০১৩ সালে মেরিন ও মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকার প্রথম এবং একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে এবং ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১২তম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। নীল অর্থনীতি অর্জনের লক্ষ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেরিন ক্যাডেটদের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ‘ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স’ ডিগ্রি দেওয়া হবে।

নীল সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে নীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জনের ক্ষমতা লাভ করেছে। এর একটি হলো প্রাণিজ আরেকটি অপ্রাণিজ। প্রাণিজের মধ্যে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা-গুল্মলতা ইত্যদি। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। আরো রয়েছে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালু। যেমন জিরকন, রোটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিক্লোসিন ইত্যাদি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থলভাগের আয়তন যেখানে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার সেখানে সমুদ্রে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিমির মালিকও এখন বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক তথ্য বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে, বাংলাদেশ তার শীর্ষে রয়েছে। বর্তমানে গড়ে ছয় লাখ টন মাছ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়। বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ নীল অর্থনীতি থেকে আসে। বর্তমানে আমাদের জেলেরা ৩৫ থেকে ৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে থেকে মাছ আহরণ করেন, কিন্তু আমাদের সমুদ্রে অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। গভীর সমুদ্র পর্যন্ত গিয়ে মাছ আহরণ করতে পারলে বাংলাদেশের মৎস্য রপ্তানিতে সৃষ্টি হবে নতুন মাইলফলক, তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত।

বঙ্গোপসাগরকে বলা হয় সম্পদের ভাণ্ডার। তেল, গ্যাসসহ নানা মূল্যবান পদার্থের খোঁজ মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এতসব সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এই সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। নীল অর্থনীতিতে নেই পর্যাপ্ত সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ। মাছ ধরার ট্রলার, সমুদ্র ভ্রমণে পর্যটন, মালামাল পরিবহন ছাড়া তেমন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এই খাতকে বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় কওে তুলতে হবে বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে।

সমুদ্র অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এ সমুদ্র অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ, নৌপরিবহন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পানিসম্পদ এবং বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত। কেউ কেউ এ সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে ‘সমুদ্রসম্পদ মন্ত্রণালয়’ নামে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করেছেন। দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার প্রায় সমপরিমাণ ৮১ শতাংশ সম্পদ সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে। সমুদ্রের তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে তা টেকসই উন্নয়নের জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্যসম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। অপার সম্ভাবনাময় এ খাতকে কাজে লাগানো জরুরি। সমুদ্রের তলদেশে কী ধরনের সম্পদ রয়েছে, সেগুলো আহরণ করতে হলে কোন ধরনের প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ জনবল প্রয়োজন তা পরিকল্পনামাফিক নির্ধারণ করে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি। নীল অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন আমাদের দেশে আলোচনা চলছে। এ খাতের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো দ্বিমত নেই। বাংলাদেশ সরকারও নীল অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সমুদ্র গবেষণা, খনিজসম্পদ অনুসন্ধান, সঠিক পরিসংখ্যান বিনিয়োগের পরিবেশ, মেগা প্রকল্প, নৌ ও বন্দর ব্যবহার সুবিধা ইত্যাদি। যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে নীল অর্থনীতি হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির আরো একটি উল্লেখযোগ্য খাত । বাংলাদেশের এই বিশাল সমুদ্রসীমাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারলে নীল অর্থনীতি হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। নীল সমুদ্রের এই সম্ভাবনায় খাতকে যথাযথ গুরুত্ব ও পরিকল্পনা মাফিক ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবি।

মো. জিল্লুর রহমানঃ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button