ব্যাসেল-৩ পরিপালনে ইসলামি ব্যাংকিং
ড. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফাঃ ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনবিধান। জীবনের যতগুলো দিক ও প্রয়োজন আছে, সব দিক ও প্রয়োজন সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। অধিকার ও পাওনা যথাযথভাবে প্রকৃত প্রাপককে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারের হাতে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। আর লোকদের মধ্যে ফায়সালা করার সময় ‘আদল’ ও ‘ন্যায়নীতি’-সহকারে ফয়সালা করো। আল্লাহ তোমাদের বড়ই উৎকৃষ্ট উপদেশ দান করেন। আর অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও দেখেন (৪: ৫৮)।’
ব্যাংক হলো এক ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাভের বিনিময়ে সঞ্চয় (আমানত) গ্রহণ করে এবং প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ আমানত হিসেবে সংগ্রহ করে মূলধন গড়ে তোলে এবং তা ব্যবসায়ীদের মাঝে ঋণ হিসেবে প্রদান করে। ব্যাংক আমানত গ্রহণ ও ঋণ সেবার বাইরেও সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের বিনিময়ে বিভিন্ন আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক একটি দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। অর্থনীতির বিকাশের জন্য প্রয়োজন উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করা। সেই লক্ষ্যে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে হালাল ও পবিত্র করতে এবং সুদের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইসলাম অর্থ ব্যবস্থাপনায় এমন সব নীতিমালা উপহার দিয়েছে, যেগুলো ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও আবিষ্কারের এ আধুনিক যুগেও সব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ইসলামি পন্থায় পরিচালিত করার জন্য মূলনীতি তৈরির চেষ্টা চলছে। এ প্রচেষ্টার সর্বপ্রথম সফলতা হলো ইসলামিক পদ্ধতিতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা।
ব্যাংকের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ আবশ্যক। পুঁজির ওপরেই ব্যাংকের স্থায়িত্ব ও উন্নতি নির্ভরশীল। ইসলামিক ব্যাংক টাকাকে পণ্য না মনে করে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে, কারণ টাকার কোনো নিজস্ব মূল্য নেই। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকগুলো টাকাকে মূল ব্যবসায়ী পণ্য মনে করে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা করে। ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ হলো আমানতকৃত অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করা। আর বিনিয়োগের ফলে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। এই ঝুঁকির পরিমাণ নির্ভর করে কোন খাতে বিনিয়োগ করা হলো তার ওপর। সুতরাং ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগ করা ব্যাংকের প্রধান কাজ। ফলে কম ঝুঁকিসম্পন্ন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় ইসলামি ব্যাংকগুলো এগিয়ে রয়েছে কৌশলগত কারণে।
কারণ প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সীমা অসীম, যেহেতু ব্যাংকগুলো উৎপাদনশীল, অনুৎপাদনশীল, ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও অন্যান্য যে কোনো খাতে ঋণ বা বিনিয়োগ করতে পারে, কিন্তু ইসলামি ব্যাংকগুলো উৎপাদনশীল ও শরিয়াহ্সম্মত খাত ছাড়া অন্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারে না। সুতরাং ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সীমা সসীম। ব্যাংক হচ্ছে এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার মূলধনের তুলনায় দায়ের পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ গুণ বা এর বেশি হয় থাকে। অন্য সাধারণ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেখানে ঋণ ও মূলধন অনুপাত ১:১ অনুপাতকে আদর্শ অনুপাত ধরা হয়, সেখানে ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঋণ ও মূলধনের অনুপাত ১০:১ অনুপাতকে আদর্শ অনুপাত ধরা হয়।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
অনিশ্চয়তা থেকে ক্ষতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাকে ঝুঁকি বলে। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগ থেকে ভরিষ্যতে রিটার্নের পরিবর্তনশীলতাকে ঝুঁকি বলে। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করে, তার ফলে যে ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকির সৃষ্টি হয়, তার সমষ্টিকে পোর্টফোলিও ঝুঁকি বলে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে পোর্টফোলিও ঝুঁকির সৃষ্টি হয়, কারণ ব্যাংক বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ প্রদান করে। ফলস্বরূপ, পোর্টফোলিও ঝুঁকি গঠনের মাধ্যমে বিনিয়োগের ঝুঁকি হ্রাস করা ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ব্যাংকিং কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার জন্য ঝুঁকি পরিমাপ করতে হয়। ব্যাংকগুলো তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঝুঁকির মুখোমুখি হয়। ব্যাংকের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হলো প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করা। প্রধানত তিনটি ঝুঁকির বিষয়ে ব্যাসেল নীতিমালায় আলোচনা করা হয়েছে। সেগুলো হলো ক্রেডিট বা ঋণ ঝুঁকি, অপারেশনাল বা পরিচালনাগত ঝুঁকি ও মার্কেট বা বাজার ঝুঁকি।
অপারেশনাল বা পরিচালনাগত ঝুঁকির মধ্যে আছে-
১. অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জালিয়াতি,
২. আইন ঝুঁকি,
৩. ক্ষতি, শ্রম ও স্বাস্থ্য,
৪. শারীরিক সম্পদের ক্ষতি এবং
৫. ব্যবসায়িক বাধা।
মার্কেট বা বাজার ঝুঁকিগুলো হলো-
১. সুদের ঝুঁকি,
২. ইক্যুইটি অবস্থানের ঝুঁকি,
৩. বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি এবং
৪. পণ্য ঝুঁকি।
পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ৫৮ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষের আমানতসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণের পর তা ফেরত দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকের আমানতকৃত অর্থ যাতে তছরুপ না হয়, সে বিষয় এবং উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তা সংরক্ষণ করা ব্যাংকগুলোর নৈতিক দায়িত্ব।
ব্যাসেল কমিটি:
ব্যাসেল কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ব্যাসেল-১, ব্যাসেল-২ ও ব্যাসেল-৩ নামে তিনটি চুক্তি জারি করেছে। ব্যাসেল চুক্তি হচ্ছে ব্যাংকিং তদারকি-সম্পর্কিত ব্যাসেল কমিটি কর্তৃক গৃহীত নীতিমালা ও সুপারিশসমূহ। যেগুলোর মুখ্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য কার্যকরভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ব্যাংকের পুঁজির গুণগত মান রক্ষা করা, ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং ঝুঁকিভিত্তিক পুঁজির সুরক্ষা, স্বল্পমেয়াদি তহবিলের ওপর ব্যাংকগুলোর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা এবং ব্যাংকিং মার্কেটে মারাত্মক সংকট দেখার পর ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে জি-১০ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের নিয়ে ব্যাসেল কমিটি গঠিত হয়।
গ্রুপ অব টেন ১১টি শিল্পোন্নত দেশ নিয়ে গঠিত, তার মধ্যে সাতটি ছিল ইউরোপীয় দেশ, যথা বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন। বাকি দেশগুলো হলো- কানাডা, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী ব্যাসেল শহরে একটি কমিটি গঠিত হয়, যা ‘ব্যাংকিং কমিটি অব ব্যাংকিং সুপারভিশন (বিসিবিএস) নামে পরিচিত। এটি ১৯৮৮ ব্যাসেল চুক্তি নামেও পরিচিত। এই কমিটি গঠনের মূলে ছিল ‘ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট’ (বিআইএস) নামক বিশ্বের প্রাচীনতম আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার সদর দপ্তর ব্যাসেল শহরে এবং এটি ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকের দুটি শাখা অফিস হংকং ও মেক্সিকো সিটিতে অবস্থিত। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্যসংখ্যা ৪৫।
ব্যাসেল কমিটি এখন পর্যন্ত তিনটি ব্যাংকিং পরিচালনা ও মূলধন সংরক্ষণ-সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাসেল-২-এর আলোকে মূলধন সংরক্ষণ ও ঋণ ঝুঁকির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৪ জারি করে, যা ২০০৯ সাল থেকে বাস্তবায়ন করা শুরু হয়। এই ব্যাংকিং প্রবিধানগুলো একসঙ্গে কার্যকর করা হয়নি। এটি কয়েক বছরের একটি প্রক্রিয়া। এই ব্যাংকিং প্রবিধানগুলি ১৯৮০ থেকে ২০১১-এর মধ্যে বিকশিত হয়েছিল বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে।
আমাদের জানা উচিত, কোন প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ব্রাসেলসের ‘ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টে ব্যাংক’-এর নেতৃত্বে ‘ব্যাংকিং কমিটি অব ব্যাংকিং সুপারভিশন (বিসিবিএস)’ নামে কমিটি গঠন করে।
ব্যাসেল কমিটি গঠনের প্রেক্ষাপট:
আরব-ইসরাইল যুদ্ধ (১৯৭৩ সালের ৬-২৪ অক্টোবর) ১৮ দিনব্যাপী চলে, যা ইতিহাসে চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে ইসরাইলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো অর্থনৈতিক ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে ইসরাইলের বাহিনীকে সাহায্যের কারণে আরব বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করে। ফলে ১৯৭৪ সালের মধ্যেই তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি তিন ডলার থেকে বেড়ে ১২ ডলার পর্যন্ত হয়ে যায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ও পশ্চিমা দেশগুলো রাতারাতি অস্বাভাবিকভাবে মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে যায় দেশগুলো।
অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের (বিশ্বব্যাংক) কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ শুরু করে দেয় পশ্চিমা দেশগুলো। অপরদিকে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে এই ঋণগুলোর ওপরে এতটাই বেশি সুদ চলে আসে, যেটা পরিশোধ করা ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর সাধ্যের বাইরে চলে যায়। এদিকে ওপেকভুক্ত দেশগুলো তেল বিক্রি বাবদ যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছিল, তার উদ্ধৃত্ত অর্থ আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেলে জমা রাখে, ফলে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্যের সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো সেই অতিরিক্ত তহবিল বিনিয়োগ করেছিল তখনকার সময়ের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল বিনিয়োগ অঞ্চল লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয়। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেই ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি।
প্রথমে ১৯৮২ সালে লাতিন আমেরিকার দেশ মেক্সিকো ঘোষণা করল তার পক্ষে আর বৈদেশিক ঋণের কিস্তি দেয়া সম্ভব নয়। ফলে ঋণদানকারী ব্যাংকগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়ল এবং ঋণের অর্থ সুদে-আসলে আদায় করতে তৎপরতা শুরু করল। ফলাফল হলো আরও ভয়াবহ খারাপ, কারণ অধিকাংশ ঋণই ছিল স্বল্পমেয়াদি। যখন পশ্চিমা দেশগুলো একসঙ্গে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করল, তখন সেই ঋণগুলোই আরও উচ্চসুদে শ্রেণীকরণ করে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো। ওই ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে দেশগুলো তাদের সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম স্থগিত করে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করতে লাগল।
ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে গেল, বেকারত্ব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি আর ক্রয়ক্ষমতা হ্র্রাস পাওয়ায় জনগণের দুর্ভোগ চরমে উঠে গেল। তখন জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিল, যার ফলে ঋণদানকারী ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে পতিত হয় এবং ক্রেডিট বা ঋণ ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অবস্থা থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার জন্য ব্যাসেল কমিটি গঠিত হয়। বিশ্বের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপ্রবণ সম্পদের হ্রাসকরণ ও আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু নীতিমালা বা আর্দশ জারি করে, যা ব্যাসেল আদর্শ নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালে গঠিত ব্যাসেল কমিটি দীর্ঘ ১৩ বছর পর ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে প্রথম ব্যাসেল-১ নীতিমালা ঘোষণা করে।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংক কি বা ব্যাংক কাকে বলে?
◾ বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ধনী ব্যক্তির (ঋণ আদায়ে) গড়িমসি করা জুলুম। (বোখারি শরিফ হাদিস নং-২৪০০)। আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা (আখিরাতে) নবীগণ, সিদ্দীকগণ (সত্যবাদীগণ) ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে। (জামে আত-তিরমিজি হাদিস নং-১২০৯)।
ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো, আমানতকৃত অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ বা বিনিয়োগ করার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। যে কোনো দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে উৎপাদনশীল শিল্প-কারখানাগুলো, যারা আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। সামাজিক কল্যাণ সাধন ও জাতীয় আয় বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচ্ছন্ন ও নিখুঁত হওয়া জরুরি। সে লক্ষ্যে আমাদের দেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রম বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততা ও নৈতিকতার গুণ সৃষ্টি করা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। প্রচলিত ব্যাংকিং ধারায় ওইসব কাজ করা জরুরি নয়। কারণ প্রচলিত ব্যাংকগুলো যে কোনো খাতে বিনিয়োগে আইনগত কোনো বাধা নেই। যার ফলে প্রচলিত ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ বা বিনিয়োগে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি থাকে। অন্যদিকে শরিয়াহ সম্মত ব্যাংকিং দ্ধারা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ তুলনামূলক কম। উপরোক্ত হাদিস দুটি পর্যালোচনা করলে এ কথা আমরা বলতে পারি, সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিনিয়োগ করলে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে; অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হ্রাস পাবে। আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ী সামর্থ্য থাকার পরও যথাসময়ে ঋণের বা বিনিয়োগের টাকা পরিশোধ করেন না। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, সেই সঙ্গে ক্রেডিট বা বিনিয়োগ ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যাসেল–১–এর মৌলিক কাঠামো ও এর প্রয়োগ:
ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার পরিপ্রেক্ষিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা মোকাবিলার জন্য ১৯৭৪ সালে গঠিত ‘ব্যাংকিং কমিটি অব ব্যাংকিং সুপারভিশন (বিসিবিএস)’ নামে ব্যাসেল কমিটি ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে ব্যাসেল-১ মূলনীতি জারি করে, যা ভারত ১৯৯৯ সালে গ্রহণ করে। এই ব্যাসেল আদর্শ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রথমে ব্যাসেল-১ বাস্তবায়ন করা হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তুলনায় ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ৮ শতাংশ। ২০০৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হার ১০ শতাংশ করা হয়। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ মূলধনের সঙ্গে আরও ২.৫০% মূলধন বাড়ানোর জন্য নীতিমালা করা হয়। অতিরিক্ত ২.৫০% মূলধনের বিশেষ নাম দেয়া হয়েছে তা হলো Capital Conservation Buffer. এটা নির্ধারিত হবে জরংশ Risk Weighted Asset বিপরীতে। সে ক্ষেত্রে ২.৫০%কে ৪ দিয়ে ভাগ করে প্রত্যেক বছর ০.৬২৫ শতাংশ হারে পর্যায়ক্রমে বাড়াতে হবে। যদি কোনো ব্যাংকের ক্যাপিটালের নিচে নেমে যায়, তবে ব্যাংক সে বছর কোনো প্রকার ডিভিডেন্ট প্রদান করতে পারবে না।
ব্যাসেল-১ অনুযায়ী Credit কে শুধু ব্যাংকের Risky Asset বিবেচেনায় নিয়ে তার বিপরীতে Minimum Capital Requirement নির্ধারণ করা হয়। যার প্রধান ফোকাস ছিল ঋণ বা ক্রেডিট ঝুঁকি হ্রাস করা এবং সে লক্ষ্যে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করা।
ব্যাসেল-১-এর গুরুত্ব:
ব্যাসেল-১ ছিল বিসিবিএসের প্রথম চুক্তি। প্রধানত একটি ব্যাংকের সম্পদ ঝুঁকির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করে ক্রেডিট ঝুঁকির হার নির্ধারণ করা ছিল অন্যতম লক্ষ্য। বিসিবিএস প্রবিধানের আইনি শক্তি নেই। সদস্য রাষ্ট্রগুলো ব্যাসেল-১ পরিপালনে তাদের নিজ নিজ দেশে বাস্তবায়নের জন্য দায়ী থাকে। ব্যাসেল-১ মূলত ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তার অনুপাত ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ৮% সংরক্ষণের জন্য ১৯৯২ সালের শেষের দিকে বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানায়।
ব্যাসেল-১-এর সুবিধা:
ব্যাসেল-১-এর মূলনীতি হলো ভোক্তা এবং প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্য ঝুঁকি হ্রাস করা। যেহেতু ব্যাসেল-২ ব্যাসেল-১কে ছাড়িয়ে যায়নি, তাই অনেকগুলো ব্যাংক ব্যাসেল-৩ সংযোজন দ্বারা পরিপূরক মূল ব্যাসেল-১ কাঠামোর অধীনে কাজ শুরু করে। ব্যাসেল-১ বেশিরভাগ ব্যাংকের ঝুঁকি প্রোফাইল কমিয়ে দেয়; ফলে ২০০৮ সালে সাব-প্রাইম বন্ধকি পতনের পর যে ব্যাংকগুলো যথার্থভাবে অবিশ্বস্ত ছিল তাদের বিনিয়োগ ফেরত নিয়ে যায়। ব্যাসেল-১ ব্যাংকের সেই অতি প্রয়োজনীয় মূলধন প্রবাহের পেছনে চালিকাশক্তি ছিল। ব্যাসেল-১-এর সম্ভবত সবচেয়ে বড় অবদান ছিল যে, এটি ব্যাংকিং প্রবিধান এবং সর্বোত্তম অনুশীলনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো, যা ব্যাংক, ভোক্তা এবং তাদের নিজ নিজ অর্থনীতিকে রক্ষা করে এমন অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পথ সুগম করে।
ব্যাসেল-১-এর জন্য প্রয়োজনীয়তা:
ব্যাসেল-১ ক্রেডিট ঝুঁকিকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে, যা শতকরা হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ: ০%, ১০%, ২০%, ৫০% ও ১০০%। একটি ব্যাংকের সম্পদ ঋণ/বিনিয়োগ গ্রহীতার প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিভুক্ত করা হয়। শ্রেণিগুলো হলো: ০% ঝুঁকি শ্রেণিতে রয়েছে নগদ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারি ঋণ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের জন্য কোনো সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) সরকারের ঋণ নিয়ে গঠিত। খাতভিত্তিক ঋণ গ্রহীতার ওপর নির্ভর করে পাবলিক সেক্টরের ঋণ ০%, ১০%, ২০% বা ৫০% বিভাগে রাখা যেতে পারে। ২০% ঝুঁকি শ্রেণিতে রয়েছেÑডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ঋণ, ওইসিডি ব্যাংকের ঋণ, ওইসিডি সিকিউরিটিজ ফার্মের ঋণ, নন-ওইসিডি ব্যাংকের ঋণ (এক বছরের নিচে পরিপক্বতা), নন-ওইসিডি পাবলিক সেক্টরের ঋণ এবং নগদ সংগ্রহে। ৫০% ঝুঁকি শ্রেণিতে রয়েছে আবাসিক বন্ধকি। ১০০% ঝুঁকি শ্রেণিতে রয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ/বিনিয়োগ, নন-ওইসিডি ব্যাংকের ঋণ (এক বছরের বেশি পরিপক্বতা), রিয়েল এস্টেট, উদ্ভিদ ও সরঞ্জাম এবং অন্যান্য ব্যাংকে জারি করা মূলধন (শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি)।
ব্যাসেল-১ অনুসারে, ব্যাংককে অবশ্যই তার ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের কমপক্ষে ৮% সমান মূলধন (টিয়ার-১ এবং টিয়ার-২) বজায় রাখতে হবে। এটি নিশ্চিত করে যে, ব্যাংকগুলো বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন ধরে রাখে। উদাহরণস্বরূপ যদি একটি ব্যাংকের ৪০০০ মিলিয়ন টাকার ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থাকে, তাহলে কমপক্ষে ৩২০ মিলিয়ন টাকার (৮% হিসাবে) ন্যূনতম মূলধন বজায় রাখা প্রয়োজন। টিয়ার-১ মূলধন ব্যাংকের সবচেয়ে তরল এবং প্রাথমিক তহবিল উৎস। টিয়ার-২ মূলধন হলো কম তরল সম্পন্ন মূলধন, ঋণ-ক্ষতি এবং পুনর্মূল্যায়ন মজুদ ও অপ্রকাশিত মজুদ।
ব্যাসেল পরিপালনে সাধারণত টিয়ার-১ মূলধন ও টিয়ার-২ মূলধন, যেসব উপাদান নিয়ে গঠিত হয় তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
টিয়ার-১ মূলধন (কোর ক্যাপিটাল):
টিয়ার-১ মূলধন ব্যাংকের রিজার্ভে থাকা মূল মূলধনকে বোঝায় এবং ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্য ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত তহবিল। টিয়ার-১ ক্যাপিটালের দুটি উপাদান রয়েছে: কমন ইক্যুইটি টিয়ার-১ এবং অতিরিক্ত মূলধন। কমন ইক্যুইটির মধ্যে রয়েছেÑসম্পূর্ণ পরিশোধিত মূলধন, বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি, অ-পরিশোধেয় শেয়ার প্রিমিয়াম হিসাব, সাধারণ সঞ্চিতি, অবণ্টিত মুনাফা, মাইনোরিটি ইন্টারেস্ট ইন সাবসিডিয়ারিজ, অপুঞ্জীভূত অপরিশোধযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার এবং লভ্যাংশ সমতাকরণ হিসাব। এখান থেকে বাদ যাবে সুনামের বহিঃমূল্য ও অস্পর্শনীয় সম্পত্তি ইত্যাদি (যদি থাকে)। টিয়ার-১ মূলধন দ্বারা যে কোনো ব্যাংকের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপ করা যায়। টিয়ার-১ মূলধন একটি ব্যাংকের ইকু্যুইটি মূলধন এবং প্রকাশিত মজুদ বোঝায়। এটি ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা পরিমাপ করতে ব্যবহƒত হয়। টিয়ার-১ মূলধন অনুপাত একটি ব্যাংকের ইক্যুইটি মূলধনকে তার মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের সঙ্গে তুলনা করে। এগুলো হলো ব্যাংকের সম্পদের সংকলন, যা ক্রেডিট ঝুঁকির ওপর নির্ভর করে। ব্যাসেল-১-এর অধীনে যে ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করে তাদের অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের কমপক্ষে ৪% টিয়ার-১ ন্যূনতম মূলধন বজায় রাখতে হবে।
টিয়ার-২ মূলধন (সাপ্লিমেন্টারি ক্যাপিটাল):
টিয়ার-২ ক্যাপিটাল শব্দটি ব্যাংকের প্রয়োজনীয় রিজার্ভের একটি উপাদানকে বোঝায়। টিয়ার-২ একটি ব্যাংকের মূলধনের দ্বিতীয় বা পরিপূরক টিয়ার হিসেবে মনোনীত। সাধারণ প্রভিশন (অশ্রেণিকৃত বিনিয়োগ এবং অব ব্যালান্সশিট আইটেম), সম্পদের পুনর্মূল্যায়িত সঞ্চিতি ৫০% পর্যন্ত, সিকিউরিটিজের পুর্নমূল্যায়িত সঞ্চিতি ৫০% পর্যন্ত, ইক্যুইটির পুনর্মূল্যায়িত সঞ্চিতি ১০% পর্যন্ত, অন্যান্য অগ্রাধিকার শেয়ার, পারপিচুয়াল সাব-অর্ডিনেট ডেট (গচই) কোর ক্যাপিটালের ৩০% এবং অন্যান্য (যদি থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত) নিয়ে টিয়ার-২ মূলধন গঠিত। টিয়ার-২ ক্যাপিটাল তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং কম গুণগত মান সম্পূর্ণ হওয়ায় এবং তা পরিমাপ করা কঠিন হওয়ায় টিয়ার-২ ক্যাপিটালকে Supplimentary Capital বলা হয়। ব্যাংকের মূলধনের প্রয়োজনীয়তাগুলো আন্তর্জাতিক ব্যাসেল চুক্তি অংশ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। এই সুপারিশের সেটটি ১৯৮০ দশকের দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংক তত্ত্বাবধানের ব্যাসেল কমিটি দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। প্রবিধান অনুসারে ব্যাংকগুলোকে তাদের দায়বদ্ধতা পূরণের জন্য হাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অথবা তরল সম্পদ বজায় রাখতে হয়। ব্যাসেল-১-এর অধীনে যে ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করে তাদের অবশ্যই তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের কমপক্ষে ৪% টিয়ার-২ ন্যূনতম মূলধন বজায় রাখতে হবে।
ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ (RWA):
ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বলতে সাধারণত যে ঋণ বা বিনিয়োগ ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে আদায় করতে হলে ঝুঁকি নিতে হয় তাকে বুঝায়। সমস্ত অনাদায়ী ঋণই হলো ঝুঁকিপ্রবণ সম্পদ। অতএব ব্যাংকের মোট সম্পদের মধ্যে যে সম্পদগুলো ঝুঁকি বহন করে তার সমষ্টিকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বলে।
মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (CAR):
মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত হলো এমন একটি অনুপাত, যার দ্বারা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার যে দায়সমূহ আছে, তা পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই, ঋণ ঝুঁকির প্রতি ব্যাংকের সাড়া এবং অপারেশনাল ঝুঁকির প্রতি ব্যাংকের সাড়া দেয়ার সক্ষমতা যাচাই করা যায়। মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত এর মান যে ব্যাংকের যত বেশি, সেই ব্যাংকের সম্ভাব্য ক্ষতি বা ঝুঁকি এড়ানোর সক্ষমতা তত বেশি বলে ধরে নেয়া হয়। ফলে ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা যেমন কম থাকে, তেমনি আমানতকারীদের আমানত হারানোর সম্ভাবনাও কম থাকে। রেগুলেটরি ক্যাপিটালকে (টিয়ার-১ ও ২) মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করলে মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত নির্ণয় করা হয়।
ব্যাসেল–১: ক্রেডিট ঝুঁকি ফোকাস
ব্যবসায়ের ইতিহাস বেশ পুরোনো। পুরোনো দিনের ব্যবসা যুগের পর যুগ অতিবাহিত হয়ে আজকের আধুনিক বিশ্বে পদার্পণ করেছে। এর মূলে রয়েছে ব্যাংকিং ব্যবসার উৎপত্তি। ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মূল চাহিদা অর্থের জোগান দিয়ে থাকে আধুনিক ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং ব্যবসায়ে রয়েছে সফলতা এবং ব্যর্থতা ও ঝুঁকি সবই। তাই ব্যাংকগুলোকে প্রদেয় বিনিয়োগ বা ঋণের ঝুঁকি বহন করতে হয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৭, ২০০৩ সালের ৭ অক্টোবর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন প্রদান করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগটি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।
সে কারণেই ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি এবং ডিপোজিট বিনিয়োগ অনুপাত দিন দিন বাড়ছে। তাই বিনিয়োগ বা ঋণের টাকা সময়মতো পরিশোধ করার ব্যাপারে ইসলামে দিকনির্দেশনা রয়েছে। ঋণ গ্রহীতার দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে ‘আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে তার পাওনা আদায়ের কড়া তাগাদা দিল। সাহাবায়ে কিরাম তাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হলেন। তিনি বলেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, পাওনাদারের কথা বলার অধিকার রয়েছে। তার জন্য একটি উট কিনে আন এবং তাকে দিয়ে দাও। তাঁরা বললেন, তার উটের চেয়ে বেশি বয়সের উট ছাড়া আমরা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, সেটিই কিনে তাকে দিয়ে দাও। কারণ তোমাদের উত্তম লোক সেই, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে। (বুখারি শরিফ হাদিস নং-২৩৯০)।’
ক্রেডিট–ঋণের ইতিকথা:
ইংরেজিতে ‘ক্রেডিট’ অর্থাৎ ঋণ শব্দটি ১৫২০ সালে ব্যবহার হয়। এই শব্দটি মধ্যযুগীয় ফরাসি শব্দ ক্রেডিট (বিশ্বাস, আস্থা) ইতালীয় শব্দ ক্রেডিত, লাতিন শব্দ ক্রেডিয়াম ‘ঋণ, যা অন্যকে বিশ্বাস করে দেয়া’, ক্রেডিয়ারের ক্রিয়াবাচক পুরাঘটিত অতীত শব্দ ‘বিশ্বাস করা, আস্থা রাখা, নির্ভর করা’ থেকে উদ্ভূত। ঋণের ব্যবসায়িক অর্থ, যা শুরুতে ইংরেজিতে ব্যবহার হতো তাই বোঝায়, ক্রেডিটার শব্দটি ঋণদাতা অর্থে ব্যবহার ১৫শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। ‘ঋণদান সংঘ’ এই ব্যুৎপন্ন শব্দটি মার্কিনিরা ইংরেজি শব্দ হিসেবে প্রথম ব্যবহার হয় ১৮৮১ সালে। আরেকটি শব্দ ‘ক্রেডিট রেটিং’ ব্যবহার হয় ১৯৫৮ সালে।
ঝুঁকি ধারণার ইতিকথা:
বুর্জোয়া শব্দটি ফরাসি। যার অর্থ হলো দেয়াল ঘেরা শহর। তবে ব্যবহারিক অর্থে বুর্জোয়া বলতে তখনকার দিনের শহরে বসবাসকারী মানুষজনকেই বুঝানো হতো। বুর্জোয়া শব্দের প্রয়োগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে। যখন শহুরে মধ্যবিত্ত পেশাজীবী এবং উৎপাদক শ্রেণি তাদের অর্থনৈতিক পদমর্যাদার ওপর ভিত্তি করে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী হয়। এসব শহুরে পেশাজীবী এবং ব্যবসায়ী শ্রেণির আগ্রহেই ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয় বলেই কার্ল মার্কস এবং আরও অনেক চিন্তাবিদ এ বিপ্লবকে ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কার্ল মার্কসের ধারণা ছিল, দিনশেষে এই চূড়ান্ত বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে এবং শোষণ, শ্রেণি সংগ্রাম ও রাষ্ট্রের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটবে সাম্যবাদের। বুর্জোয়ারা তখন তাদের সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক অধিকারের দাবিতে ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্প বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল।
তখন বুর্জোয়া অর্থনৈতিক কাঠামোর উত্থানের সময়কালে প্রকৃতি এবং ঝুঁকির সারাংশ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত গবেষণা শুরু হয়েছিল। বাণিজ্যিক-ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সভ্যতা এবং শিল্প সম্পর্কের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক চিন্তার মহান মন ক্রমবর্ধমান মুনাফা এবং ঝুঁকির মধ্যে সম্পর্কের দিকে মনোযোগ দেয়। প্রথমবারের মতো, অ্যাডাম স্মিথ তার লেখায় এই সম্পর্কে লিখেছিলেন। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল এল. হেইন, পিটার জে বোয়েটকে এবং ডেভিড এল প্রিচিটকো তাদের রচিত ‘দ্য ইকোনমিক ওয়ে অব থিংকিং’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে কোম্পানিগুলোর মুনাফার উত্থানের শর্ত হলো অনিশ্চয়তা এবং সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি। ঝুঁকি অধ্যয়ন এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রের উত্থান এবং সক্রিয় বিকাশ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের যুগে ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চিহ্নিত হুমকির অবস্থাকে আরও বিস্তৃতভাবে আর্থিক ফলাফলের সম্ভাবনা, প্রত্যাশিত ইভেন্ট সিরিজের বিচ্যুতি এবং নেতিবাচক পরিণতির ঘটনার সম্ভাব্য মূল্যায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুমতি দেয়। যাই হোক না কেন, এটা মনে রাখতে হবে যে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো ঝুঁকি নেই এবং তার গ্রহণের বিষয় ছাড়া ঝুঁকির কোনো বস্তু নেই।
ঝুঁকির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ:
ঝুঁকি হলো অনিশ্চয়তার যে অংশটুকু পরিমাপ করা যায়; প্রত্যাশিত আয়ের পরিবর্তনশীলতা; খারাপ কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা এবং প্রত্যাশা হতে বিচ্যুতির যে সম্ভাবনা তা মূলত ঝুঁকি। অনিশ্চয়তা হতে ক্ষতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাকে ঝুঁকি বলে। ঝুঁকি হলো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বা কোনো সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভবিষ্যৎ আয়ের তারতম্য। ঝুঁকির আরেকটি ধারণা হলো, উত্থান-পতন। আয়ের উত্থান-পতন যত বেশি হবে, ঝুঁকিও তত বেশি হবে। সব অনিশ্চয়তাই ঝুঁকি নয়। ঝুঁকির কারণে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাক্সিক্ষত ফলাফল না পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আদর্শ বিচ্যুতি বা পরিমিত ব্যবধান, পরিসর ও বিভেদাঙ্ক এসব পদ্ধতির মাধ্যমে ঝুঁকি পরিমাপ করা যায়। ঝুঁকি ও আয়ের মধ্যে ধনাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সফলভাবে পরিচালনার জন্য ঝুঁকি পরিমাপ করা অত্যাবশ্যক। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে ঝুঁকির তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো ঝুঁকির উৎস খুঁজে বের করা ও শ্রেণি বিন্যাস করা। উদাহরণ স্বরূপ ওয়ান ব্যাংক আল-নূর ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ২০২০ সালে ৩১ ডিসেম্বরে ২০ শতাংশ নিট মুনাফার টার্গেট ছিল কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত মুনাফা হয়েছে ১৫ শতাংশ। এখানে ৫ শতাংশ বিচ্যুতিকে ঝুঁকির উৎস বলে। কিন্তু যদি প্রত্যাশার বেশি লাভ হতো (৩০ শতাংশ) তাহলেও ঝুঁকির উৎস বলে বিবেচিত হতো, কারণ অধিক আয়ের কারণ অজানা ছিল। সুতরাং ঝুঁকি পরিমাপ করা যায় বলে তা কমানো বা হ্রাস করা যায়। সুতরাং আর্থিকমূল্যে পরিমাপযোগ্য ক্ষতিই হচ্ছে ঝুঁকি।
ক্রেডিট ঝুঁকি:
সাধারণত ঋণ প্রদান কার্যক্রমের মাধ্যমে ঋণ ঝুঁকির উদ্ভব হয়। এই ঝুঁকি ব্যাংকের অন ব্যালান্স শিট আইটেম ও অফ ব্যালান্স শিট আইটেম থেকে সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ গ্রহীতার পূর্বনির্ধারিত চুক্তি পালনে অক্ষমতা বা অনিচ্ছা থেকে এই ঝুঁকির উদ্ভব ঘটে। ঋণগ্রহীতা কর্তৃক শর্ত মোতাবেক সকল দায় (সুদ, আসল ও অন্যান্য চার্জ) পরিশোধের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তাকে বোঝায়। বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি হলো হ্রাসযোগ্য, পরিমাপ যোগ্য ও পরিহার যোগ্য। কোনো বিনিয়োগের প্রকৃত আয় থেকে প্রত্যাশিত আয়ের পার্থক্যকেই বিনিয়োগ ঝুঁকি বলা হয়। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগ থেকে ভবিষ্যৎ রিটার্নের পরিবর্তনশীলতাকে ঝুঁকি বলে। সুতরাং কোনো বিনিয়োগের আয় যত অনিশ্চিত হবে তার পরিবর্তনশীলতা তত বেশি হবে এবং ঝুঁকিও তত বেশি হবে আর আয় যত নিশ্চিত হবে তার পরিবর্তনশীলতা তত কম হবে এবং ঝুঁকিও কম হবে।
একটি আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ক্রেডিট ঝুঁকি বা ক্রেডিট ডিফল্ট ঝুঁকি কেবল সেই লেনদেনের প্রত্যাশিত ক্ষতি। এটি সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে – ক্রেডিট রিস্ক = ডিফল্ট সম্ভাব্যতা E এক্সপোজার E ক্ষতির হার।
ডিফল্ট সম্ভাব্যতা হলো একজস দেনাদার তার ঋণ পরিশোধে প্রত্যাহার করার সম্ভাবনা। এক্সপোজার হলো ঋণদাতাকে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করার কথা। বেশিরভাগে ক্ষেত্রেই এটি কেবল ঋণগ্রহীতার দ্বারা ধার করা এবং সুদের অর্থপ্রদানের পরিমাণ। ‘ক্ষতির হার = ১ – পুনরুদ্ধার হার’ যেখানে পুনরুদ্ধার হার হলো মোট পরিমাণের অনুপাত, যা যদি দেনাদার খেলাপি হয়ে যায়। ক্রেডিট ঝুঁকি বিশ্লেষকরা ক্রেডিট ঝুঁকির প্রতিটি নির্ধারক বিশ্লেষণ করে এবং একটি প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি হওয়া সামগ্রিক কমানোর চেষ্টা করে।
ক্রেডিট ঝুঁকি সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ:
ক্রেডিট ঝুঁকি সাধারণত ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে বা ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হলে উদ্ভব হয়, যা প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জন ও মূলধনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটি ঋণের একাধিক অস্তিত্ব দেখা দিলে বা একটি ঋণ যখন প্রয়োজন ব্যতীত বর্ধিত করা হয় তখন এই ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ (করোনাভাইরাস, টর্নেডো, সিডর, আইলা, ভূমিকম্প, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্টি হয়)। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা/অস্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদিও ঋণ ঝুঁকি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ঋণের প্রাক্কলন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম-বেশি হলে ঋণের ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত সময়ে ঋণ বিতরণ করা না হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করলে ঝুঁকির উদ্ভব হয়। অসৎ কর্মকর্তারা কর্তৃক নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদানের ফলে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত তদারকির অভাবে ঋণ ঝুঁকির উদ্ভব হয়। এছাড়া ব্যবসায়িক কার্যক্রমে যে কোনো ধরনের ক্রুটির কারণে ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে।
ক্রেডিট/ বিনিয়োগ ঝুঁকির মৌলিক উপাদান:
ব্যাংক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আর ব্যবসায়ের সঙ্গে ঝুঁকি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় ঝুঁকি গ্রহণ করা আবশ্যক। সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকি বাদ দেয়ার কোনো সুয়োগ নেই; কারণ ব্যাংক মালিকের মূলধন ছাড়াও জনগণের আমানত নিয়ে তার মোট মূলধন গঠন করে। যেহেতু মালিকের মূলধনের তুলনায় ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত আমানত থাকে, সেহেতু তার ঝুঁকির মাত্রাও ১০ থেকে ২০ গুণ। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের আমানত রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত গাইডলাইন প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করা। যে দেশের আইনি কাঠামো যত মজবুত সেদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো তত শক্তিশালী।
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি কাঠামোর পাশাপাশি নৈতিক গুণাবলির ভিত্তিতে গড়ে তুলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি ব্যাংক আমানতকৃত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে থাকে, তাই মুনাফার সঙ্গে ঝুঁকি জড়িত। ঝুঁকি হ্রাস করার নিমিত্তে বিনিয়োগের অর্থ সময়মতো পরিশোধ করার সুফল সম্পর্কে আবু হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত নবী সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের মাল (ধার) নেয় পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহতায়ালা তা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে তা নেয় বিনষ্ট করার নিয়তে আল্লাহতায়ালা তাকে ধ্বংস করেন। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং ২৩৮৭)
ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ঝুঁকি চিহ্নিত, পরিমাপ ও হ্রাস করার জন্য ২০০৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রস্তাবগুলোর ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য ঝুঁকি গ্রেড স্কোর কার্ড প্রবর্তনের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৬ সালের ৮ মার্চ বিআরপিডি সার্কুলার নং ৪-এর মাধ্যমে ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ঝুঁকিগুলো আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূভাবে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে প্রণীত ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশে কার্যরত কিছু তফসিলি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির পর্যবেক্ষণ ও স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে সংশোধনী আনয়ন করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৫ সালের নভেম্বরে ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং ম্যানুয়াল জারি করে। ওই ম্যানুয়ালে উল্লিখিত ক্রেডিট/ঋণ বা বিনিয়োগ ঝুঁকির মৌলিক উপাদানগুলোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাঁচটি মৌলিক উপাদানের ২৫টি ঝুঁকিভিত্তিক উপাদান নির্ধারণ করা হয়েছে, যাদের মোট মান ১০০ ধরে ঝুঁকির মাত্রার ওপর নির্ভর করে শ্রেণি বিন্যাস করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ ধারাবাহিকভাবে ঝুঁকিগুলোর মানসহ আলোচনা করা হলো।
(১) আর্থিক ঝুঁকি (ফাইন্যান্সিয়াল রিস্ক) ৫০ শতাংশ:
১.১ লিভারেজ ঝুঁকি (লিভারেজ) ১৫ শতাংশ, ১.২ তারল্য ঝুঁকি (লিকুইডিটি) ১৫ শতাংশ,
১.৩ লাভজনকতা ঝুঁকি (প্রফিট্যাবিলিটি) ১৫ শতাংশ এবং ১.৪ কভারেজ ঝুঁকি (কভারেজ) ৫ শতাংশ।
(২) ব্যবসায়িক ঝুঁকি (বিজনেস ইন্ডাস্ট্রি রিস্ক) ১৮ শতাংশ:
২.১ ব্যবসার আকার (সাইজ অব বিজনেস) ৫ শতাংশ,
২.২ ব্যবসার বয়স (এজ অব বিজনেস) ৩ শতাংশ,
২.৩ বিজনেস আউটলুক (বিজনেস আউটলুক) ৩ শতাংশ,
২.৪ শিল্প বৃদ্ধি (ইন্ডাস্ট্রি গ্রোথ ৩ শতাংশ,
২.৫ বাজার প্রতিযোগিতা (মার্কেট কম্পিটিশিন) ২ শতাংশ এবং
২.৬ প্রবেশ বা প্রস্থান বাধা (এন্ট্রি/এক্সিট ব্যারিয়ারস) ২ শতাংশ।
(৩) ব্যবস্থাপনা ঝুঁকি (ম্যানেজমেন্ট রিস্ক) ১২ শতাংশ:
৩.১ অভিজ্ঞতা (এক্সপেরিয়েন্স) ৫ শতাংশ, ৩.২ উত্তরাধিকার (সাকসেশন) ৪ শতাংশ এবং
৩.৩ দলবদ্ধভাবে সম্পাদিত কাজ (টিমওয়ার্ক) ৩ শতাংশ।
(৪) নিরাপত্তা ঝুঁকি (সিকিউরিটি রিস্ক) ১০ শতাংশ:
৪.১ সিকিউরিটি কভারেজ (সিকিউরিটি কাভারেজ) coverage ৪ শতাংশ, ৪.২ কুলাটারাল কভারেজ ৪ শতাংশ এবং ৪.৩ সমর্থন ২ শতাংশ।
(৫) পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকি ১০ শতাংশ:
৫.১ হিসাব পরিচালনা (Account conduct) ৫ শতাংশ,
৫.২ ইউটিলাইজেশন অব লিমিট (Utilization of limit) ২ শতাংশ,
৫.৩ চুক্তি বা শর্ত মেনে চলা (Compliance of covenants/ condition) ২ শতাংশ এবং
৫.৪ ব্যক্তিগত আমানত (Personal deposit) ১ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উদ্দেশ্য সাধনে ঝুঁকির প্রভাব রয়েছে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে ঝুঁকি জড়িত থাকে। ঝুঁকি কীভাবে হ্রাস করা যায় তার কৌশল নির্ধারণ করা প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে মৌলিক দায়িত্ব। ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য প্রথমে ঝুঁকি চিহ্নিত করতে হবে এবং ঝুঁকি পরিমাপ করতে হয়। ঝুঁকি পরিমাপের জন্য ঝুঁকির উৎস ও শ্রেণি খুঁজে বের করা জরুরি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং ম্যানুয়াল জারি করেন। ঝুঁকিগুলো সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করা হলো।
(১) আর্থিক ঝুঁকি ৫০ শতাংশ:
আর্থিক ঝুঁকি হলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের পর তা আদায়ের ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়; প্রতিষ্ঠানের মূলধন কাঠামোয় ঋণ অর্থ ব্যবহারে ফলে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা; বহিঃস্থ উৎস থেকে অর্থায়ন করলে; দায় পরিশোধের অক্ষমতা থেকে এবং কারবারে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাকেই আর্থিক ঝুঁকি বলে। আর্থিক ঝুঁকির কারণে কোম্পানির দ্রুত বিলোপসাধন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর্থিক ঝুঁকি বিনিয়োগকারীকে বহন করতে হলে মালিক ও কর্মচারীদের ব্যবসায়িক ঝুঁকি বহন করতে হয়। যে প্রতিষ্ঠানের ঋণ-মূলধন বেশি, সে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ঝুঁকি বেশি। সরকার করের হার বৃদ্ধি করলে ব্যবসায়ীদের বেশি করে কর দিতে হয়, ফলে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ঝুঁকির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মূলধন কাঠামো পরিবর্তন করে আর্থিক ঝুঁকি পরিহার করা যায়। প্রতিষ্ঠানের মূলধন কাঠামোতে ঋণ করা মূলধন বেশি থাকলে আর্থিক ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের আর্থিক ঝুঁকিগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকগুলোর জন্য আর্থিক ঝুঁকিকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন এবং তাদের মান নির্ধারণ করেছেন। সেগুলো হলো
১.১ লিভারেজ ঝুঁকি ১৫ শতাংশ:
সাধারণভাবে লিভারেজ মানেই অন্যের পরিবর্তে একটি চলকের প্রভাব। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় লিভারেজ খুব আলাদা নয়, এর অর্থ একটি উপাদানের পরিবর্তন ও লাভের পরিবর্তন। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অত্যধিক অন-এবং অফ ব্যালেন্স লিভারেজ পরিহার করার জন্য একটি সহজ, স্বচ্ছ, অঝুঁকিভিত্তিক লিভারেজ অনুপাত চালু করা হয়েছে। লিভারেজ অনুপাত ঝুঁকিভিত্তিক মূলধনের প্রয়োজনীয়তাগুলোর একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পূরক পরিমাপ হিসেবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ‘গাইডলাইসস অন রিস্ক বেসড ক্যাপিটাল অ্যাডেকোয়েস’ ২০১৪ সালে বিআরপিডি সার্কুলার নং- ১৮ জারি করে। উক্ত সার্কুলার বাস্তবায়নের জন্য লিভারেজ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৮, ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট জারি করে। সে আলোকে উক্ত গাইডলাইন্সের ৪নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে এবং ব্যাংকের মূলধন ও দায়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যাসেল-৩ কাঠামোর আলোকে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার পাশাপাশি তফসিলি ব্যাংকসমূহকে ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম শতকরা ৩ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত সংরক্ষণ করার নির্দেশনা করার প্রদান করা হয়।
উক্ত গাইডলাইন্সের ৪.৪ নং অনুচ্ছেদে ২০১৭ সাল হতে উক্ত লিভারেজ অনুপাত পুনবির্ন্যাস করার পরিকল্পনার বিষয় উল্লেখ করা হয়। ব্যাসেল-৩ কাঠামো অনুযায়ী ব্যাংকের মোট টিয়ার-১ মূলধন ও মোট সম্পদের অনুপাতকে লিভারেজ অনুপাত বলা হয়। ২০১৯ সাল থেকে দেশের ব্যাংকিং খাতে সম্পূর্ণরুপে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করা হলেও ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার ন্যায় ব্যাংকের লিভারেজ অনুপাত তুলনামূলকভাবে কাম্যস্তরে বৃদ্ধি পায়নি। লিভারেজ অনুপাত কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীতকরণের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যে তফসিলি ব্যাংকসমূহের আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিক আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। অধিকন্তু, লিভারেজ অনুপাত বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকের গুনগত মূলধন বৃদ্ধি পাবে; যার ফলে অপ্রত্যাশিত ক্ষতির বিপরীতে ব্যাংকের ঝুঁকি সহনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য লিভারেজ অনুপাত ২০২৩ সাল থেকে বার্ষিক ০.২৫ শতাংশ হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপূর্বক বিদ্যমান ৩ শতাংশের স্থলে ২০২৬ সালের মধ্যে ৪ শতাংশে উন্নীত করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। সে হিসাবে ২০২৩ সালে ৩.২৫ শতাংশ, ২০২৪ সালে ৩.৫০ শতাংশ, ২০২৫ সালে ৩.৭৫ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৪.০০ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত সংরক্ষণ করতে হবে।
১.২ তারল্য ঝুঁকি ১৫ শতাংশ:
কোনো একটি সম্পদ সহজে নগদ টাকায় রূপান্তর করতে না পারার সম্ভাবনাই হচ্ছে তারল্য ঝুঁকি। যে বাজারে শেয়ার, বন্ড এবং ডিবেঞ্চার ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয় হয় সে বাজারের আকার ও কাঠামোর ওপর তারল্য ঝুঁকির নির্ভর করে। বিনিয়োগ (সম্পত্তি) বিক্রয় করার অনিশ্চয়তা থেকে তারল্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। যে কোনো সম্পত্তিই বিক্রয় করা যায়; তবে সেক্ষেত্রে অনেক সময় বাট্টা দিতে হয়। তবে সম্পত্তি বিক্রি করতে যত বেশি বাট্টা দিতে হবে, তত বেশি তারল্য ঝুঁকি হবে। সে জন্য বাজারের আকার ও প্রকৃতির ওপর তারল্য ঝুঁকি নির্ভর করে। ব্যাংকের তারল্য ঝুঁকি বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো, খেলাপি ঋণ বা বিনিয়োগ বৃদ্ধি। তারল্য ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য রিয়েল সেক্টর ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা।
১.৩ লাভজনকতা ঝুঁকি ১৫ শতাংশ:
লাভজনকতা ঝুঁকি হলো ব্যাংকের প্রত্যাশিত লাভের তুলনায় প্রকৃত লাভ যদি কম বা বেশি হয় তাহলে লাভজনকতা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এই ঝুঁকির প্রধান উপাদন হলো বিনিয়োগ। বিনিয়োগকৃত মূলধন যদি প্রত্যাশিত লাভসহ যথাসময়ে ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তা যত বেশি হবে লাভজনকতার ঝুঁকি তত বেশি হবে। সুতরাং লাভজনকতা ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য বিনিয়োগ আয় ও অন্যান্য পরিচালন আয় বৃদ্ধি ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
১.৪ কভারেজ ঝুঁকি ৫ শতাংশ:
কভারেজ হলো ব্যাংকের ঋণ বা বিনিয়োগ পরিষেবা এবং তার আর্থিক বাধ্যবাধকতা পূরণ করার ক্ষমতার একটি পরিমাপ। কভারেজ যত বেশি হবে, তার ঋণ বা বিনিয়োগের সুদ বা লভ্যাংশ প্রদান করা তত সহজ হবে। ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের কভারেজ অনুপাতের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কভারেজ ঝুঁকি চিহ্নিত, পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হলো ব্যবসা। ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য। ব্যাংক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো আর্থ-সামাজিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে জনগণের উদ্বৃত্ত অর্থ সংগ্রহ এবং তা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা। ব্যাংক তার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে যেসব কাজকর্ম করে থাকে, তাকে ব্যাংকিং বলে। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার সময় ঝুঁকির উৎপত্তি হয়। ঝুঁকি ব্যাংকিং ব্যবসার প্রধান আলোচনার বিষয়, ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিগুলোর কারণে প্রায়ই ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। একটা ব্যাংক কতটুকু সফল হবে তা নির্ভর করবে ব্যাংকিং কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য নীতিনির্ধারণ, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের ওপর।
সে লক্ষ্যে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য কৌশল নির্ধারণ করে। ব্যাংক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে ঝুঁকি গ্রহণের নিমিত্তে মুনাফা অর্জন করে। ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থ যাতে যথাসময়ে ফেরত পাওয়া যায় সে লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের কাছে শরিয়াহর নির্দেশনাগুলো তুলে ধরতে হবে। ঋণ বা বিনিয়োগের টাকা পরিশোধ না করার কুফল সম্পর্কে আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মুমিন ব্যক্তির রুহ ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তার ঋণের সঙ্গে বন্ধক অবস্থায় থাকে। সুনানে তিরমিজি-১০৭৮। অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির প্রকারভেদ উল্লেখ করেছেন; তবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং কাঠামো ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যবসায়িক ঝুঁকিকে’ ছয়টি উপাদানে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলোÑব্যবসার আকার, ব্যবসার বয়স, বিজনেস আউটলুক, শিল্প বৃদ্ধি, বাজার প্রতিযোগিতা এবং প্রবেশ বা প্রস্থানে বাধা।
(২) ব্যবসায়িক ঝুঁকি (১৮ শতাংশ):
অনিশ্চিত ব্যবসায়িক পরিবেশের কারণে বিনিয়োগ থেকে মুনাফার অনিশ্চয়তাকে ব্যবসায়িক ঝুঁকি বলে। ব্যবসায়িক ঝুঁকি হলো বাজারের অবস্থার পরিবর্তন, গ্রাহকের চাহিদা, সরকারি বিধিবিধান এবং ব্যবসায়ের অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে তুলনামূলকভাবে কম লাভের উপার্জন বা ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা। ব্যাংকের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং কার্যক্রম থেকে প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জনে কোনোরূপ অনিশ্চয়তা দেখা দিলে, পরিচালন ব্যয় পরিশোধের অক্ষমতা এবং অতিরিক্ত স্থায়ী খরচের প্রবণতা থেকে ব্যবসায়িক ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়িক ঝুঁকি হলো একটি অপদ্ধতিগত ঝুঁকি। ব্যবসায়িক ঝুঁকির কারণ হলো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার ভুল সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব, অদক্ষতা, দেশীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্যে প্রতিকুল পরিবর্তন, নতুন প্রতিযোগীর আবির্ভাব। ব্যবসায়িক ঝুঁকি পরিহার করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না করে স্বল্প মেয়াদি বিনিয়োগ করা যেতে পারে। ব্যবসায়িক ঝুঁকি পরিহারের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় ইসলামি ব্যাংকগুলো এগিয়ে।
কারণ ইসলামিক ব্যাংকগুলো উৎপাদনশীল ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী শরিয়াহ সম্মত পণ্য-দ্রব্যে বিনিয়োগ করে থাকে। অন্যদিকে প্রচলিত ব্যাংকগুলো উৎপাদনশীল, অনুৎপাদনশীল এবং যে কোনো পণ্য-দ্রব্যে বা ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে থাকে। যার ফলে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি হয়ে থাকে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইসলামিক ব্যাংকগুলোর তুলনায় প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে বেশি। এ ধরনের ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণের অন্যতম প্রধান উপায় হলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। ব্যাংকের ক্ষেত্রে ইবিআইটি পরিবর্তনশীলতার মাধ্যমে ব্যবসায়িক ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। পরিবর্তনশীলতা হলো ইবিআইটি, যা ইপিএসকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক চিহ্নিত ব্যবসায়িক ঝুঁকি গুলো হলো
(২.১) ব্যবসার আকার (৫ শতাংশ):
প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের পরিধির ওপর ঝুঁকি নির্ভর করে। ব্যবসার পরিধি বেশি হলে মুনাফার পরিমাণও বেশি হবে। মুনাফা যত বেশি ঝুঁকি তত বেশি। ব্যবসায়ের সাফল্য ব্যবসার আকার বা পরিধির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান বড় হলে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য সমসাময়িক ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়। বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ঝুঁকি পরিমাপ, চিহ্নিত ও হ্রাস করা অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং কিন্তু তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেকটাই কম। এটা হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আকার। সাধারণত বাংলাদেশি টাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান/শিল্পে একটি আর্থিক বছরে মোট বিক্রয় আয়ের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে স্কোর প্রদান করা হয়। বিক্রয় আয় ৬০.০০ কোটি টাকার বেশি হলে স্কোর ৫ এবং ২.৫০ কোটির কম হলে স্কোর হবে শূন্য।
(২.২) ব্যবসার বয়স (৩ শতাংশ):
ব্যবসায়িক কাজে কত বছর নিয়োজিত রয়েছে তার হিসাব। এ ক্ষেত্রে যে ব্যবসা শুরু করা হয়েছে, তার কোনো পরিবর্তন না করে ব্যবসায়ে নিয়োজিত থাকার ব্যাপ্তি। ব্যবসা পরিবর্তন করা হলে পরিবর্তিত অবস্থার ব্যাপ্তি বুঝাবে। ব্যবসার ব্যাপ্তি ১০ বছরের বেশি হলে স্কোর ৩ এবং ২ বছরের কম হলে স্কোর হবে শূন্য। যে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাফল্য অনেকাংশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বয়সের ওপর নির্ভর করে। যে প্রতিষ্ঠানের বয়স বেশি সে প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বেশি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বয়স বিবেচ্য বিষয়। ব্যাংক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য ব্যবসার বয়স বিবেচনা করে।
(২.৩) বিজনেস আউটলুক (৩ শতাংশ):
বিজনেস আউটলুক হলো কোনো প্রতিষ্ঠান একটি শিল্পে বা বাজারে বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কতটুকু অবদান রাখছে তার হিসাব। বিনিয়োগ গ্রাহক তার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাজারের কত অংশ তার অবদান রয়েছে তার একটি তুলনামূলক চিত্র মূল্যমান করা হয়। বিনিয়োগকৃত পণ্য বা দ্রব্য যদি অর্থনীতিতে যথেষ্ট অনুকূল (favourable) হয় তবে তার ধরা হয় স্কোর-৩, স্থায়ী(Stable) হলে ২, কিছুটা অনিশ্চিত হলে তার স্কোর হবে ১। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ প্রদানের পূর্বে ঝুঁকি পরিমাপ করার জন্য বিজনেস আউটলুক যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে থাকে।
(২.৪) শিল্প বৃদ্ধি (৩ শতাংশ):
শিল্প (উৎপাদন ও সেবা) প্রবৃদ্ধি অর্জনে একটি উদ্দীপ্ত ও গতিশীল ব্যক্তি খাত সৃষ্টি এবং দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে থাকে। শিল্প বৃদ্ধি হলো প্রার্থিত বিনিয়োগের উদ্দেশ্যটি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির কত অংশ। যেমন চা উৎপাদন। এ পণ্যটির সামগ্রিক চাহিদা, সরবরাহ, দেশে বিদ্যমান উৎপাদন ইত্যাদির গবেষণালব্ধ ফলাফল হতে এর Gi Demand-supply Gap ঢ় নির্ণয় করে এর প্রয়োজনীয়তা শতকরা হারে নির্ণয় করা। এক্ষেত্রে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ ব্যাংকগুলো অন্যতম দায়িত্ব। যে প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি কম সে প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি বেশি। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য প্রবৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।
(২.৫) বাজার প্রতিযোগিতা (২ শতাংশ):
দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি অবস্থা পরিবর্তনের ফলে বিনিয়োগকৃত সম্পত্তির মূল্য হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যে ঝুঁকির উদ্ভব হয় তাকে বাজার ঝুঁকি বলে। বাজার প্রতিযোগিতা হলো প্রার্থিত বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যটির বাজারে কীরূপ প্রতিযোগিতা, দক্ষতা বা প্রভাব রয়েছে তার মাত্রা নির্ণয়। পণ্যটি বাজারে প্রভাবশালী (Dominant Player) হলে স্কোর হবে ২, মাঝারি প্রতিযোগী (Moderate competitive) হলে স্কোর হবে ১ এবং প্রতিযোগী বেশি (Highly competitive) হলে স্কোর হবে শূন্য। প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক পরিবেশে ব্যাংকগুলোকে কাজ করতে হচ্ছে। কারণ ব্যাংকিং খাতে এখন উদ্বৃত্ত তারল্য অনেক। কিন্তু বিনিয়োগের সুযোগ কম। তাই বিভিন্ন ব্যাংক বিভিন্ন অফার দিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যাংক খাতে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ঝুঁকির মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। এ ধরনের ঝুঁকি হ্রাসের জন্য প্রয়োজন দেশের সব ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন কাঠামো তৈরি করা, যাতে আমানত গ্রহণ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতা না করতে পারে।
(২.৬) প্রবেশ বা প্রস্থান বাধা (২ শতাংশ):
প্রবেশ বা প্রস্থান বাধা এটি হলো উৎপাদিত পণ্য বা সেবা বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বৈরিতা আছে কিনা তা মূল্যায়ন করা হয়। বিনিয়োগকৃত পণ্যটি যদি বাজারজাত করণে কোনো বাধা না থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীর লাভজনকতা বৃদ্ধি পাবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রবেশ বা প্রস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়। প্রতিকূলতার মাত্রা বেশি হলে স্কোর হবে ২, তুলনামূলক কম হলে স্কোর হবে ১ এবং কোনো বৈরিতা বা বাধা না থাকলে স্কোর হবে শূন্য।
(৩) ব্যবস্থাপনা ঝুঁকি (১২ শতাংশ):
প্রকৃত ফলাফল প্রত্যাশিত ফলাফল থেকে ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাকে ঝুঁকি বলে। ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির উদ্ভব হয় মূলত অভিজ্ঞতা, উত্তরাধিকার পরিকল্পনা এবং পারস্পরিক সহযোহিতা বা টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা কারণে। ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য অভিজ্ঞতা, উত্তরাধিকার এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
(৩.১) অভিজ্ঞতা (৫ শতাংশ):
কোনো বিষয়বস্তুর ওপর নানা রকম জ্ঞান পূর্ব থেকেই অর্জন করাকে অভিজ্ঞতা বলে। তাই অভিজ্ঞতা হচ্ছে কারবারের ব্যবস্থাপনার দক্ষতা। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মূল মালিক/উচ্চতর পর্যায়ের মূল ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সহিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার অভিজ্ঞতা হিসাব। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার স্কোর নির্ধারণ হয় মূলত ১০ বছরের জন্য ৫; ৫-১০ বছরের জন্য ৩; ১-৫ বছরের জন্য ১ এবং কোনো দক্ষতা না থাকলে শূন্য। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যবস্থাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(৩.২) উত্তরাধিকার (৪ শতাংশ):
এটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটির মূল মালিকানা/ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের ধারা বা গতির বিশ্লেষণ করাকে বুঝায়। ব্যবস্থাপনায় বা মালিকানায় কোনো পরিবর্তন না হলে স্কোর ৪, ১-২ বছরের মধ্যে পরিবর্তন হলে স্কোর ৩, ২-৩ বছরের মধ্যে পরিবর্তন হলে ২। উত্তরাধিকার ঝুঁকিতে যদি কোনো প্রস্তাব শূন্যও পায় তাহলেও বিনিয়োগটি গ্রহণযোগ্য স্কোর পাওয়ার সুযোগ থাকে। ব্যাংকঋণ বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্রাহকের উত্তরাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত উত্তরাধিকার আছে কিনা, তা যাচাই করা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য। কারণ সঠিক সময়ে বিনিয়োগের টাকা পরিশোধের মাধ্যমে দায়িত্বশীল উত্তরাধিকার ঝুঁকি হ্রাসে ভূমিকা রাখে।
(৩.৩) দলবদ্ধভাবে সম্পাদিত কাজ (৩ শতাংশ):
টিমওয়ার্ক বলতে বোঝায় দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। প্রতিষ্ঠানে সফলতা নির্ভর করে মূলত পারস্পরিক সহযোগিতা বা টিমওয়ার্কের ওপর। পারস্পরিক সহযোগিতা মূল্যায়নের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে চলছে কিনা বা ব্যবস্থাপনার কোনো ত্রুটি আছে কিনা তা মূল্যায়ন করা হয়। সে লক্ষ্যে বিনিয়োগ প্রার্থী টিকওয়ার্কের ধরন কেমন তা যাচাই করা ব্যাংকিং কার্যক্রমের অন্যতম অংশ। কারণ প্রত্যেকের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা যদি একত্রে কাজে লাগানো যায় তাহলে প্রতিষ্ঠানের আসা ঝুঁকিগুলো হ্রাস করা সহজ হয়। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা খুব ভালো হলে স্কোর ৪, মোটামুটি হলে ২, খারাপ হলে ১ এবং ব্যবস্থাপনায় অসহযোগিতা থাকলে স্কোর শূন্য হবে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের প্রধান উপাদান হলো ব্যাংক খাত, যা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অপরিহার্য। বিশেষ করে ২০০৮-২০১২ সালের বিশ্বমন্দা-পরবর্তী সময়ে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক প্রধান হাতিয়ার এবং আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং বিকাশের ক্ষেত্রে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কারণ ব্যাংকের সংখ্যা বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামোর তুলনায় বেড়েছে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নতুন নতুন ব্যাংকিং পণ্য ও সেবার পরিধি বাড়ছে। ফলে সম্ভাবনার পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য নতুন নতুন ঝুঁকির উৎস। কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা অর্জন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি সময়ের দাবি। ঝুঁকি নির্মূল পন্থা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক উপাদান। ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় ইসলামি ব্যাংকগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কারণ যেসব বিনিয়োগ গ্রাহক দেউলিয়া হওয়ার কারণে বিনিয়োগ পরিশোধ করতে পারেন না, সেসব বিনিয়োগ গ্রাহকের পাওনা ইসলামি ব্যাংকগুলো অনেক সময় জাকাত/সিএসআর খাত থেকে পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই; কারণ প্রচলিত ব্যাংকগুলো জাকাত তহবিল গঠনের আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তোমাদের ঋণগ্রহীতা অভাবী হলে সচ্ছলতা লাভ করা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর যদি দান করে দাও, তাহলে এটা তোমাদের জন্য বেশি কল্যাণকর হবে, যদি তোমরা অনুধাবন কর’ (সুরা বাকারা-২৮০)। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন যে, ‘তাঁর পিতা উহুদের যুদ্ধে শহিদ হন এবং তাঁর ওপর কিছু ঋণ ছিল। পাওনাদাররা তাদের পাওনা সম্পর্কে কড়াকড়ি শুরু করে দিল। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে এলাম। তিনি তাদের আমার বাগানের ফল নিয়ে নিতে এবং আমার পিতার অবশিষ্ট ঋণ মাফ করে দিতে বললেন। আর তিনি (আমাকে) বলেন, আমরা সকালে তোমার কাছে আসব। তিনি সকাল বেলায় আমাদের কাছে এলেন এবং বাগানের চারদিকে ঘুরে বরকতের জন্য দুয়া করলেন। আমি ফল পেড়ে তাদের সব ঋণ আদায় করে দিলাম এবং আমার নিকট কিছু অতিরিক্ত খেজুর অবশিষ্ট রয়ে গেল’ (বুখারি শরিফ-২৩৯৫)। বাংলাদেশ ব্যাংকঋণ বা বিনিয়োগ ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিরাপত্তাজনিত কারণে যে ঝুঁকির উদ্ভব হয় তাকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। সেগুলো হলো সিকিউরিটি কভারেজ, জামানত কভারেজ এবং সমর্থন।
(৪) নিরাপত্তা ঝুঁকি (১০ শতাংশ):
ব্যাংক আমানতকৃত অর্থ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে থাকে। মুনাফার সঙ্গে ঝুঁকির বিষয়টি জড়িত। মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হলে ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস করতে হবে। ব্যাংক যে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করবে সে প্রতিষ্ঠানের ঋণ বা বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধ করার অতীত রেকর্ড যাচাই করা ঝুঁকি হ্রাসের একটি অন্যতম পদ্ধতি। এছাড়া বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক উপযুক্ত জামানত গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন তা হলো সিকিউরিটি কভারেজ; কুলাটারাল কভারেজ এবং সমর্থন।
(৪.১) সিকিউরিটি কভারেজ (৪ শতাংশ):
সিকিউরিটি কভারেজ হলো, প্রত্যাশিত বিনিয়োগের তুলনায় জামানতের অনুপাত। বিনিয়োগের পরিমাণের চেয়ে জামানতের পরিমাণ যত বেশি হবে বিনিয়োগ তত নিরাপদ হবে। জামানতের গুণগত মানের ওপর বিনিয়োগ থেকে সৃষ্ট ঝুঁকির পরিমাণ নির্ভর করে। সে লক্ষ্যে জামানতের পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গে গুণগত দিকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রত্যাশিত বিনিয়োগের বিপরীতে জামানতের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়। প্রাথমিক জামানত যদি সম্পূর্ণ পণ্য বন্ধকি হয় বা বিনিয়োগের বৃহদাংশ কোনা নগদ সম্পদ (স্থায়ী আমানত/বন্ড ইত্যাদি) বা নিবন্ধিত বন্ধক হয়, যদি নিবন্ধিত বন্ধক হয়, তবে স্কোর হবে ৪, রেজিস্টার্ড হাইপোথিকেশনের ক্ষেত্রে ১ম চার্জ হলে স্কোর হবে ৩, দ্বিতীয় চার্জ হলে ২, সাধারণ হাইপোথিকেশন হলে স্কোর হবে ১ এবং কোনো জামানত না থাকলে স্কোর হবে শূন্য। প্রতিটি ব্যাংক বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য সিকিউরিটি কভারেজের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ প্রদান করে থাকে।
(৪.২) জামানত (Collateral) কভারেজ (৪ শতাংশ):
জামানত কভারেজ হলো জামানতকৃত সম্পত্তির অবস্থানের মূল্যায়ন করে গ্রেডিং করা। সিটি করপোরেশন, জেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে এবং জামানতকৃত সম্পত্তির সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সহজেই বিক্রয় যোগ্য তাহলে নিবন্ধিত বন্ধকের (Registered Mortgage) ক্ষেত্রে স্কোর হবে ৪, পৌরসভা/উপজেলা/উপশহর বা তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা হলে সেক্ষেত্রে স্কোর হবে ৩, কোনো জমি বা Equitable Mortgage না হয়ে যদি Plant and Machinery হয় তবে সে ক্ষেত্রে স্কোর হবে ২। জামানতবিহীন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্কোর হবে শূন্য।
(৪.৩) সমর্থন (Support) (২ শতাংশ):
অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের জামানত দিয়ে বিনিয়োগ গ্রহণ করার মতো উপযুক্ত জামানত নেই। কিন্তু মার্কেটের তাদের বেশ সুনাম রয়েছে। নীতি নৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে গ্রহকের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের ব্যবসায়িক পরিধি বৃদ্ধির জন্য ঋণ বা বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত বা করপোরেট গ্যারান্টি নিয়ে বিনিয়োগ প্রদান করে থাকে। উচ্চ নিট সম্পদ (High Net Worth)যুক্ত ব্যক্তিগত অথবা করপোরেট গ্যারান্টির ক্ষেত্রে স্কোর হবে-২, মোটামুটি নিট সম্পদযুক্ত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে স্কোর হবে-১, কোনো গ্যারান্টি না থাকলে স্কোর শূন্য হবে।
(৫) পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকি (১০ শতাংশ):
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ, কাঠামো ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার সময় যে সকল ঝুঁকির উৎপত্তি হয় তার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকি অন্যতম। বাংলাদেশ ব্যাংক পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকিকে চারটি উপাদানে ভাগ করেছে। সেগুলো হলো হিসাব পরিচালনা; ইউটিলাইজেশন অব লিমিট; চুক্তি বা শর্ত মেনে চলা এবং ব্যক্তিগত আমানত।
(৫.১) হিসাব পরিচালনা (৫ শতাংশ):
ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করে থাকে। ব্যাংক হিসেবে লেনদেনের পরিমাণ দেখে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কাঠামো কেমন তা যাচাই করা যায়; যার ফলে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ গ্রাহকের অতীতে গৃহীত বিনিয়োগের Performance, আর্থিক লেনদেন এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় মূল্যায়ন করা হয়। কোনো ঋণ/বিনিয়োগ হিসাবের পূর্বের ৩ বছর খেলাপি ব্যতীত সস্তোষজনক লেনদেন থাকলে স্কোর হবে ৫; খেলাপি ব্যতীত সন্তোষজনক লেনদেন ৩ বছরের কম সময় হলে স্কোর হবে ৪, নির্ধারিত বিনিয়োগের যৌক্তিক কারণে অনির্ধারিত/বিলম্বিত সময়ে পরিশোধের মাধ্যমে হিসাব নিয়মিত থাকলে স্কোর হবে ২ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে বা হিসাব অনিয়মিত থাকলে স্কোর হবে শূন্য।
(৫.২) ইউটিলাইজেশন অব লিমিট (২ শতাংশ):
ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো তার ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিনিয়োগকৃত মূলধন ব্যবহারে বিনিয়োগ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কিনা, তা যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অনাকাক্সিক্ষত যে কোনো ঘটনার কারণে ব্যবসায়িক স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এছাড়া ব্যবসায়ের প্রকৃতি, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা এবং অন্যান্য উপাদানের তারতম্যের কারণে অনেক সময় মঞ্জুরিকৃত বিনিয়োগ সীমার সম্পূর্ণ অংশ ব্যবসায়ে বিনিয়োগে করা প্রয়োজন নাও হতে পারে। সেই অনিশ্চয়তা থেকে প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকির উৎপত্তি হয়। বিনিয়োগের লিমিট ব্যবহারের ওপর ঝুঁকির মাত্রা নির্ণয় করা হয়; কারণ বিনিয়োগ বেশি হলে লাভ বেশি। মঞ্জুরিকৃত বিনিয়োগ সীমার ৬০ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত হলে স্কোর হবে ২; ৪০%-৬০% হলে স্কোর হবে ১ এবং ৪০ শতাংশের কম হলে স্কোর হবে শূন্য। সম্পূর্ণ নতুন প্রস্তাবের ক্ষেত্রে স্কোর ধরা হয় ২।
(৫.৩) চুক্তি বা শর্ত মেনে চলা (২ শতাংশ):
ব্যাংক বিনিয়োগ প্রদানের সময় বিনিয়োগ গ্রাহকের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে থাকে। বিনিয়োগ গ্রাহক কর্তৃক সেই অঙ্গীকার বা শর্তাবলি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তার ওপর প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি নির্ভর করে। ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য বিনিয়োগ গ্রাহককে মঞ্জুরিপত্রে দলিলায়নসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শর্তাদি পূরণ করার জন্য বলা হয়। অনেক বিনিয়োগ গ্রাহক এ সকল শর্তাদি পুরোপুরি পালন করতে পারেন। শর্তাদি পূরণের যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকির মান নির্ণয় করা হয়। ব্যাংক কর্তৃক উল্লিখিত শর্তাদি পরিপূর্ণভাবে পরিপালনের ক্ষেত্রে স্কোর হবে ২ এবং আংশিক পরিপালনের ক্ষেত্রে স্কোর হবে ১।
(৫.৪) ব্যক্তিগত আমানত (১ শতাংশ):
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন। ভবিষ্যতের অপ্রত্যাশিত প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যাংক বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় করে থাকে। ব্যবসায়ীরা তাদের আয়ের একটি অংশ সঞ্চয়ের ফলে কারবারের অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি হ্রাস করার চেষ্টা করে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংক বিনিয়োগ প্রদানের পূর্বে বিনিয়োগ প্রার্থী/প্রতিষ্ঠান/কোম্পানির পরিচালকদের ব্যক্তি আমানত হিসাব সম্পর্কিত বিষয়টি বিবেচনায় নেয়। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাসের উপাদান হিসেবে ব্যক্তিগত আমানত থাকলে স্কোর ধরা হয় ১ এবং ব্যক্তিগত আমানত না থাকলে স্কোর ধরা হয় শূন্য।
ব্যাসেল-১-এর প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো ক্রেডিট ঝুঁকি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং শিল্পে ২০০৯ সাল থেকে ব্যাসেল পরিপালন হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে Credi t Risk Grading Manual জারি করে ক্রেডিট ঝুঁকিকে পাঁচটি প্রধান উপাদানের অধীনে ২৫টি উপ-উপাদানে শ্রেণিভুক্ত করে। ঝুঁকিগুলোর মোট বিরময ঃ ধরা হয়েছে ১০০। সেই হিসাবে যে প্রতিষ্ঠানের বিরময ঃ যত বেশি সে প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি তত কম।
ব্যাসেল-২:
ব্যাসেল-১ বাস্তবায়নের পর থেকেই বিশ্ব ব্যাংকাররা ব্যাংক খাতের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। সারাবিশ্বের ব্যাংকগুলোই এটি বাস্তবায়ন করেছে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সাল থেকে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা জারি করে। ব্যাংক খাতের ঝুঁকি এড়াতে এবং আন্তজার্তিক মানের ব্যাংকিং ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় ব্যাসেল-২ বাস্তবায়ন করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন কাঠামো নির্ধারণের একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হলো ব্যাসেল-২। এটি ব্যাসেল কমিটির দ্বিতীয় আর্দশ, যা ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। এই আদর্শ অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যাংকে ন্যূনতম মূলধন প্রাচুর্যের অনুপাত (Capital Adequacy Ratio) ঝুঁকিপ্রবণ সম্পদের আট শতাংশ বজায় রাখতেই হবে, যাতে প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততা নিশ্চিত হয় এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।
ব্যাসেল-২-এর তিনটি পিলার
পিলার-১: Minimum Capital Requirement: ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তা ঋণ (Credit) ঝুঁকির সঙ্গে অপারেশনাল ঝুঁকি (Operation Risk) এবং মার্কেট ঝুঁকি (Market Risk) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পিলার-২: Supervisory Revenue Process: নিয়ন্ত্রক তদারকি তাদের কার্যক্রমে যেসব ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারে সেজন্য ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার বিষয়টি বিবেচনা করে। ব্যাংকগুলো সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে কি না এবং এটি সম্পর্কিত সব ঝুঁকিকে কভার করে কি না, তা নিশ্চিত করে তোলে।
পিলার-৩: Market Discipline: বাজারে শৃঙ্খলা হলো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সার্বভৌম এবং আর্থিক শিল্পের অন্যান্য বড় প্রতিযোগীদের স্টেকহোল্ডারদের জন্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে ব্যবসা পরিচালনা করা। বাজার শৃঙ্খলা একটি ব্যবসা বা সত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলোর স্বচ্ছতা এবং প্রকাশের বাজারভিত্তিক প্রচার। এটি বাজারের সুরক্ষা ও সাবলীলতা বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সিস্টেমগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে। এটি জনগণকে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ এক্সপোজারগুলো ও অন্যদের মধ্যে ঝুঁকি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে দেয়।
ব্যাসেল-২ আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতিনীতি অনুযায়ী বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা, অথবা মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ মূলধন রাখতে হয়। ব্যাসেল-২ অনুযায়ী ক্রেডিট ঝুঁকির সঙ্গে অপারেশনাল ঝুঁকি এবং মার্কেট ঝুঁকি যোগ করে মোট যে ঝুঁকি হবে তার বিপরীতে ন্যূনতম মূলধন নির্ধারিত হবে। কোনো একটি ব্যাংকের ক্রেডিট ঝুঁকি = ৮০০ টাকা; অপারেশনাল ঝুঁকি = ১০০ টাকা এবং মার্কেট ঝুঁকি = ১০০ টাকা। মোট ঝুঁকি = ১০০০ টাকা, সেই ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন হবে ১০ শতাংশ বা ১০০ টাকা; এই ১০০ টাকার মধ্যে ৫০ টাকা অবশ্যই টিয়ার-১ (ঞরবৎ-১) ক্যাপিটাল থেকে হতে হবে।
অপারেশনাল ঝুঁকি
অপারেশনাল ঝুঁকি ব্যবসায়ের তৃতীয় ধরনের ঝুঁকি। অপারেশনাল ঝুঁকিগুলো এন্টারপ্রাইজের সাধারণ ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ঝুঁকিকে বোঝায়। অপারেশনাল ঝুঁকিতে অন্তর্ভুক্ত ঝুঁকিগুলো হলো অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত জালিয়াতি, আইনগত ঝুঁকি, ক্ষতি, শ্রম ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং শারীরিক সম্পদের ক্ষতি ঝুঁকি। ব্যাসেল-২ অনুযায়ী অপারেশনাল ঝুঁকির শ্রেণিবিভাগ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো।
১. Internal & External fraud:
বড় লুটপাটের ঘটনায় অর্থনীতি ও উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বিদ্যমান। অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ/বিনিয়োগ দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়াটাই শুধু জালিয়াতি নয়, জামানতের দাম বেশি করে দেখানো কিংবা অনেক দিনের ডরমেন্ট বা বিদেশে থাকা সিনিয়রদের হিসাব থেকে টাকা সরিয়ে ফেলাও জালিয়াতির অন্তর্ভুক্ত। এমনকি প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও অনেক জালিয়াতি হয়েছে বা হচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া অর্থ আত্মসাৎ সম্ভব নয়। অনেক সময় ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেয়াই এর প্রমাণ। এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত জালিয়াত চক্র জড়িত। ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা ও পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে প্রতি চার ঘণ্টায় আর্থিক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত অন্তত একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ধরা পড়েন ও দণ্ডিত হন। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারি, হলমার্ক এবং বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতিসহ সব ধরনের জালিয়াতি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সংঘটিত হয়েছে, তা বিভিন্ন তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
২. Legal Risk:
সরকার ও আর্থিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা-সংক্রান্ত বিভিন্ন নতুন আইন প্রণয়ন করে, যা ব্যবসায়ে প্রায়ই ঝুঁকির সৃষ্টি করে। ব্যাংকের নতুন বিনিয়োগ ও মুনাফা/সুদের হার নির্ধারণ, সরকারের বিভিন্ন ট্যাক্স, রাজস্ব-সংক্রান্ত আইন, বাণিজ্যিক আইন প্রভৃতি যখন ব্যবসায়ের অনুকূলে থাকে না, তখন তা ব্যবসায়ের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১ এপ্রিল ২০২০ থেকে ক্রেডিট কার্ড ব্যতীত সব ধরনের ঋণের ওপর সুদহার ৯ শতাংশ ও আমানত সুদের হার সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ নির্ধারণ করে। সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোর জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছিল। অনেক সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা আইন/বিধান পরিবর্তন ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি করে। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঝুঁকির মাত্রা বেশি, কারণ প্রতিটি দেশে যে কোনো সময় এই ধরনের পরিবর্তন স্বাভাবিক। আইন-সংক্রান্ত ঝুঁকি পরিহার করার জন্য ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের নমনীয় নীতিমালা থাকা উচিত, যাতে সরকার তার কোনো নীতি পরিবর্তন করলেই পরিবর্তনগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৩. Losses, Labor & Health:
ব্যবসা সফল হওয়ার জন্য জনবল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার প্রধান মাধ্যম হলো ব্যাংক খাত। এ খাতের কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাই কর্মক্ষেত্রে তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অন্যতম কাজ। আর এজন্য প্রয়োজন যোগ্য ও দক্ষতা ব্যবস্থাপক, যারা ব্যাংকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে টেকসই উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। কভিড-১৯-এর প্রভাবে আর্থিক খাতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই উদ্যোক্তাদের দায়িত্ব হলো তার কর্মীদের সঠিক পরিবেশ সরবরাহ করা যাতে তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি না হয়।
৪. Damage of Physical Assets:
একটি ভৌত সম্পদ হলো অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা বিনিময় মূল্যের একটি আইটেম, যার একটি বস্তুগত অস্তিত্ব রয়েছে। ভৌত সম্পদগুলো বাস্তব সম্পদ হিসাবেও পরিচিত। ভৌত সম্পদের ক্ষতি হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যান্য ঘটনা থেকে শুরু করে ফার্মের মালিকানাধীন বা পরিচালিত ভৌত সম্পদের ক্ষতি থেকে অপ্রত্যাশিত আর্থিক বা সুনামগত ক্ষতির ঝুঁকি। এটি ব্যাসেল-২-এর নিয়ন্ত্রক কাঠামোর দ্বারা স্বীকৃত ঝুঁকি। ধারাবাহিকতা, পরিকল্পনা, নিরাপত্তা পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ধরনের ঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে। বিমা পলিসি দ্ধারাও ক্ষতি কমানো যায়।
৫. Business Interruption:
ব্যবসায় বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি বলতে কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাহত হলে যে আর্থিক ক্ষতি হয় তাকে বোঝায়। এই ক্ষতির মধ্যে উভয় ক্ষেত্রেই পর্যবেক্ষণযোগ্য উপাদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন বিক্রয় হ্রাস এবং কাজের ব্যয় বৃদ্ধি এবং লুকানো উপাদানগুলো, যেমন সম্ভাব্য খ্যাতিগত ক্ষতির কারণে ভবিষ্যতের রাজস্ব প্রবাহের ক্ষতি।
মার্কেট ঝুঁকি:
বাজার ঝুঁকি বাজারের কারণগুলোর পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগের মূল্য হ্রাস হওয়ার ঝুঁকি। এটিকে কখনও কখনও নিয়মিত ঝুঁকি বলা হয়। বাজার ঝুঁকির উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম ঝুঁকি হলো মুনাফা/সুদের হারের পরিবর্তন, ইক্যুইটি পজিশন ঝুঁকি, বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি ও কমোডিটি ঝুঁকি।
১. Profit/ Interest Rate Risk:
মুনাফা/ সুদের হারের ঝুঁকি হলো সেই ঝুঁকি, যেখানে বাজারের মুনাফা হারের পরিবর্তনে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে। মুনাফা/সুদের হারের পরিবর্তনগুলো বর্তমান আয় (উপার্জনের দৃষ্টিকোণ) পাশাপাশি ব্যাংকের নেট মূল্য (অর্থনৈতিক মূল্যের দৃষ্টিকোণ) উভয়কেই প্রভাবিত করে। তাই সুদের হার বৃদ্ধি বা হ্রাস থেকে যে ঝুঁকি আসে, তাকে সুদের হার ঝুঁকি বলে। সুদহার ঝুঁকি ব্যাংকের মৌলিক ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম। সুদহার ঝুঁকির ক্ষেত্রে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি ব্যবস্থাপকরা প্রথমে সুদ ঝুঁকি পরিমাপ করতে চেষ্টা করেন। নানা উপায়ে সুদহার ঝুঁকি পরিমাপের পরে তারা উপযুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক বা সুদহার ঝুঁকি কমানোর ব্যবস্থা করেন। বাণিজ্যিক ব্যাংক সুদহার ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রধান যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তা হলো নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বা স্প্রেড। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদ আয় হার এবং সুদ ব্যয় হারের পার্থক্যকে অর্থনীতির পরিভাষায় নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বা স্প্রেড বলে। নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন একই সঙ্গে ব্যাংকের কর্মদক্ষতা ও লাভজনকতার পরিমাপক। নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন যখন কর্মদক্ষতা নির্দেশক, তখন মনে করা হয় যে, ব্যাংকের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন যত কম, সেই ব্যাংক তত বেশি কর্মদক্ষ। অন্যদিকে লাভজনকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক উল্টো ধারণা দেয়, যে ব্যাংকের নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন বেশি, সেই ব্যাংক তত বেশি লাভজনক। এক্ষেত্রে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মদক্ষতা না লাভজনকতা এ দুটির কোনটিকে তাদের ব্যাংক ব্যবসার উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করবে, তার ওপর নির্ভর করে।
২. Equity Position Risk:
ইক্যুইটি পজিশন ঝুঁকি ইক্যুইটিতে অবস্থান বা অবস্থান নেয়ার ঝুঁকি কভার করার জন্য একটি ন্যূনতম মূলধনের মান নির্ধারণ করে। এটি ইক্যুইটিগুলোর মতো বাজারের আচরণ প্রদর্শন করে এমন সব উপকরণের দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত অবস্থানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তবে অ-পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকারপূর্ণ শেয়ারগুলোর জন্য নয়।
৩. Foreign Exchange Risk:
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ওঠা-নামার কারণে যে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, তাকে বৈদেশিক বিনিময় ঝুঁকি বলে। বৈদেশিক বিনিময় ঝুঁকি হলো অন্য মুদ্রার মধ্যে মূল্যের পরিবর্তনের অন্য যে কোনো বিদেশি মুদ্রায় বিনিয়োগকৃত মূল্যের মূল্য কমাবে। বৈদেশিক বিনিময় ঝুঁকি তিনটি ফর্ম নিচের হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
১. লেনদেন ঝুঁকি: লেনদেনের ঝুঁকি বিনিময় হারের ঝুঁকি, যা চুক্তির মধ্যে ঢুকতে এবং তা নিষ্পত্তির মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে ঘটে।
২. অনুবাদ ঝুঁকি: অনুবাদ ঝুঁকি একটি মুদ্রা থেকে অন্য মুদ্রার আর্থিক ফলাফল রূপান্তরের ফলে বিনিময় হার ঝুঁকি।
৩. অর্থনৈতিক ঝুঁকি: অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে পূর্বাভাস ঝুঁকিও বলা হয়। যখন একটি কোম্পানির বাজারমূল্য ক্রমাগত মুদ্রার ওঠানামার অনিবার্য এক্সপোজার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন বোঝায়।
৪. Commodity Risk:
পণ্য ঝুঁকি বলতে ভবিষ্যতের বাজারমূল্যের অনিশ্চয়তা এবং ভনিষ্যতের আয়ের আকার বোঝায়, পণ্যের দামের ওঠানামার কারণে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো টাকাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করে। অন্যদিকে ইসলামি ব্যাংকগুলো টাকাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে।
ব্যাসেল আদর্শের মূলকথা:
প্রাচীনকালে চীনদেশীয় সভ্যতায় ব্যাংকের ইতিহাস লক্ষণীয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালে চীন দেশে প্রতিষ্ঠিত ‘শান্সি ব্যাংক’ এর প্রমাণ। ইতিহাসে ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যযুগ বিবেচনা করা হয় ৪০০ সাল থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে। প্রকৃতপক্ষে ওই সময় থেকেই ব্যাংকের কার্যাবলি উন্নত হতে শুরু করে। আধুনিক বিশ্বের সর্বপ্রথম ব্যাংক ‘ব্যাংক অব বার্সিলোনা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪০১ সালে। সেই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান ডিজিটাল আধুনিক যুগে ব্যাংক হয়ে উঠেছে যে কোনো দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার। বিশ্বে যতগুলো অর্থনৈতিক মন্দা সংঘটিত হয়েছে, তার পেছনে ছিল ব্যাংকিং কার্যাবলির দুর্বল নীতি। ১৯৭৩ সালে সংঘটিত চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থা হুমকিতে পড়ে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি না হয়, সে দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে উন্নত বিশ্বের ১০টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের নিয়ে সুইজ্যারল্যান্ডের ব্যাসেল শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাসেল কমিটি। ব্যাসেল কমিটি কর্তৃক প্রণীত আদর্শগুলোর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্যগুলো ধারাবাহিকভাবে সংক্ষিপ্ত আকারে
উল্লেখ করা হলো। ব্যাসেল চুক্তি হচ্ছে ব্যাংকিং তদারকি-সম্পর্কিত ব্যাসেল কমিটি কর্তৃক গৃহীত নীতিমালা ও সুপারিশসমূহ (ব্যাসেল-১, ২ ও ৩), যেগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাংকের পুঁজির গুণগত মান ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
(১) ব্যাসেল কমিটির নাম: ব্যাসেল কমিটি অন ব্যাংকিং সুপারভিশন [Basel Committee on Banking Supervision (BCBS)]নামে পরিচিত, যা ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
(২) ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট: ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট’ [Bank for International Settlements (BIS)] নামে বিশ্বের প্রাচীনতম আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ব্যাসেল কমিটি গঠনের মূলে ছিল, যার সদর দপ্তর ব্যাসেল শহরে অবস্থিত।
(৩) ব্যাসেল-১: ব্যাসেল-১, ব্যাসেল আদর্শের প্রথম পিলার, যা ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই আদর্শের প্রধান লক্ষ হলো ক্রেডিট/ঋণ ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গঠন করা। এই লক্ষ্যে আট শতাংশ ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের মাধ্যমে ক্রেডিট/বিনিয়োগের ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। পাঁচটি মৌলিক উপাদানের ২৫টি ঝুঁকিভিত্তিক উপাদান নির্ধারণ করা হয়েছে, যাদের মোট মান ১০০ ধরে ঝুঁকির মাত্রার ওপর নির্ভর করে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। corporate client-এর জন্য risk হলো ১২৫ শতাংশ, তবে যদি corporate client বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে স্বীকৃত কোনো credit rating agency দ্বারা AAA হিসাবে rating পায়, তাহলে সে client–এর বেলায় risk হবে ২০ শতাংশ।
(৪) ব্যাসেল-২: ব্যাসেল-২ ব্যাসেল আদর্শের দ্বিতীয় স্তম্ভ, যা ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। এই আদর্শ তিনটি পিলারের সমন্বয়ে গঠিত, পিলারগুলো হলো (1) Minimum Capital Requirement, (2) Supervisory Revenue Process Ges (3) Market Discipline| এই আদর্শে ব্যাংকগুলোর জন্য ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তা ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আদর্শে ক্রেডিট ঝুঁকির সঙ্গে অপারেশনাল ঝুঁকি ও মার্কেট ঝুঁকি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
(৫) ব্যাসেল-৩: ব্যাসেল-৩ ব্যাসেল আদর্শের তৃতীয় স্তম্ভ, যা ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়। ব্যাসেল-২-এর তিনটি পিলারের সঙ্গে অতিরিক্ত ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তা ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত দুই দশমিক ৫০ শতাংশের নাম দেয়া হয়েছে ‘Capital Conservation Buffer যা ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। ব্যাসেল-৩-তে লিভারেজ অনুপাত বৃদ্ধি এবং তারল্য বৃদ্ধির জন্য দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।
(৬) Capital Conservation Buffer: এটা ব্যাসেল-২-এর ১০ শতাংশ সিএআরের(CAR) সঙ্গে আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্যাপিটাল যোগ করে সংরক্ষণ করাকে বলে। ২০১৫ সাল থেকে এ ক্যাপিটাল সংরক্ষণের জন্য বলা হয়। সেক্ষেত্রে ২ দশমিক ৫০-কে ৪ দিয়ে ভাগ করে প্রত্যেক বছর পর্যায়ক্রমে বাড়াতে হবে। যদি ব্যাংকের ক্যাপিটাল ন্যূনতম অনুপাতের নিচে নেমে যায়, তবে ব্যাংক সে বছর কোনো প্রকার ডিভিডেন্ড বিতরণ করতে পারবে না।
(৭) প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ: ব্যাসেল-৩-তে বলা হয়েছে, সব ব্যাংকের বিনিয়োগ ১০ শতাংশের বেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ রয়েছে, যেমন ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত, যেগুলোকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগে অবশ্যই ১০ শতাংশে নামাতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর ১০ শতাংশে অতিরিক্ত যা হবে, তাকে ১০০ শতাংশ ধরে প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে কমাতে হবে। ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে উল্লিখিত শর্তটি বাস্তবায়িত হয়েছে।
(৮) going Concern Capital: ব্যাসেল-৩-তে টায়ার-১ ক্যাপিটালকে going Concern Capital বলে। এর উপাদান দুটি যথা: Common Equity – (Tier-1) এবং Additional Equity – (Tier-1)।
(৯) one Concern Capital: ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী টায়ার-২ ক্যাপিটালকে one Concern Capital বলে।
(১০) Minimum Capital Requirement: ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে ব্যাংকগুলোকে প্রতি ত্রৈমাসিকে মূলধন পর্যাপ্ততার হার হিসাব দিতে হয়। ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তুলনায় মূলধনের অনুপাত মিনিমাম ১০ শতাংশ সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতাকে বোঝায়, যা ব্যাসেল কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত হয়।
(১১) টিআর-১ মূলধন (কোর ক্যাপিটাল): ২০১৫ সালে কোর ক্যাপিটাল তথা টিআর-১ এ ন্যূনতম মূলধনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাসেল-২ যেখানে ৪ শতাংশ ছিল সেখানে ব্যাসেল-৩-তে ৬ শতাংশ করা হয়েছে, যার মধ্যে কমন ইক্যুইটি থেকে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং অতিরিক্ত ইক্যুইটি থেকে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ করতে হয়।
(১২) টিআর-২ মূলধন (সাপ্লিমেন্টারি ক্যাপিটাল): ব্যাংকগুলোকে টিআর-২ মূলধন থেকে ৪ শতাংশ ন্যূনতম মূলধন প্রয়োজনীয়তা সংরক্ষণ করতে হয়।
(১৩) ব্যাসেল-২ রীতি অনুসারে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে আট শতাংশের (সংরক্ষিত অর্থ) টিআর-১ মূলধন থেকে ৫০ শতাংশ এবং সাপ্লিমেন্টারি ক্যাপিটাল তথা টিআর-২ মূলধন থেকে ৫০ শতাংশ রাখার বিধান করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের ফলে ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ১২ দশমিক ৫০ শতাংশের (সংরক্ষিত অর্থ) মধ্যে টিআর-১ মূলধন থেকে ৭০ শতাংশ এবং টিআর-২ মূলধন থেকে ৩০ শতাংশ রাখতে হয়।
(১৪) বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের হেড অফিস থেকে যে মূলধন আনে, তা ব্যাসেল-৩ পরিপালনের শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়।
(১৫) ব্যাসেল-৩-তে ব্যাংকের মূলধনকে ০২ (দুই) ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ব্যাসেল-২-তে মূলধনকে তিনটি টিআরে ভাগ করা হয়েছিল, যথা টিআর-১, টিআর-২ ও টিআর-৩। ব্যাসেল-৩-তে টিআর-৩ বাদ দেয়া হয়েছে। এখানে মোট মূলধনকে টিআর-১ এবং টিআর-২ ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে। আবার টিআর-১ মূলধনকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা কমন ইকুয়িটি ও এডিশনাল বা অতিরিক্ত ক্যাপিটাল।
(১৬) Banks for International Settlement (BIS) প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রথমে লিভারেজ অনুপাত ন্যূনতম ৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল, যা ব্যাসেল-৩-এর আদর্শে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি ছিল ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন প্রয়োজনীয়তার ব্যাকড্রপ হিসাবে পরিবেশন করা। সাধারণভাবে ব্যাংকগুলোকে ৩ শতাংশের বেশি লিভারেজ অনুপাত সংরক্ষণ করতে হয়। এটি মোট একীভূত ব্যাংক সম্পদের দ্বারা টিয়ার-১ মূলধনকে বিভাজন করে গণনা করা হয়। ব্যাসেল-৩ কাঠামো অনুযায়ী ব্যাংকের মোট টায়ার-১ মূলধন ও মোট সম্পদের অনুপাতকে লিভারেজ অনুপাত বলা হয়। আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানকল্পে ব্যাংকগুলোকে লিভারেজ অনুপাত ৩ শতাংশের সঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে বার্ষিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ২০২৬ সালে মধ্যে চার বছরে এক শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। অতএব মোট লিভারেজ অনুপাত চার শতাংশ সংরক্ষণ করতে হবে। যদি একটি ব্যাংকের লিভারেজ অনুপাত পাঁচ শতাংশ বা তার বেশি হয়, তখন আন্তর্জাতিকভাবে ওই ব্যাংকে উত্তম মূলধনবিশিষ্ট (well-capitalized) ব্যাংক বলা হয়। যদি চার শতাংশ হয়, তবে পর্যাপ্ত মূলধনবিশিষ্ট (Adequately capitalized) ব্যাংক বলা হয়। আর যদি ৩ শতাংশের নিচে হয়, তবে উল্লেখ্যযোগ্যভাবে নিন্ম মূলধনবিশিষ্ট (Significantly undercapitalized) ব্যাংক বলা হয়।
(১৭) ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ (RWA): ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বলতে সাধারণত যে ঋণ বা বিনিয়োগ ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে আদায় করতে হলে ঝুঁকি নিতে হয় তাকে বোঝায়। সব অনাদায়ী ঋণই হলো ঝুঁকিপ্রবণ সম্পদ। অতএব ব্যাংকের মোট সম্পদের মধ্যে যে সম্পদগুলো ঝুঁকি বহন করে, তার সমষ্টিকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বলে।
(১৮) Capital to Risk Weighted Ratio: মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত হলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে জড়িত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ব্যাংকের উপলব্ধ মূলধন অনুপাত। এই অনুপাত প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকভাবে সক্ষম থাকতে সাহায্য করে। ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রকরা প্রায়ই ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণের/বিনিয়োগের এক্সপোজারের একটি নির্দিষ্ট শতাংশকে (বর্তমান হার ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ) তার সম্পদ হিসাবে রাখতে এবং বজায় রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে। এটি শতকরা হারে প্রকাশ করা হয়। এই অনুপাত মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তুলনায় মূলধনের পরিমাণ প্রকাশ করে, যাতে আমানতকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। ব্যাসেল-২ অনুযায়ী Core Capital-এর সঙ্গে Supplimentary Capital যোগ করে Risk Weighted Asset দ্বারা ভাগ দিতে হবে।
(১৯) ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে রোডম্যাপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলার নং-১৮, তারিখ: ২১-১২-২০১৪ guidelines on Risk Based Capital Adequacy (Revised Regulatory Capital Framework for banks in line with Basel III জারি করে। এটি ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততা নিরূপণ-সংক্রান্ত নির্দেশিকা। গাইডলাইন্সের ৪নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে এবং ব্যাংকের মূলধন ও দায়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যাসেল-৩ কাঠামোর আলোকে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার পাশাপাশি তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম ৩ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
ব্যাসেল আদর্শগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো- ব্যাংকগুলোর আমানতকারীর মূলধন সংরক্ষণের মাধ্যমে গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম গতিশীল করা। ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা। বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগকৃত অর্থ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, যার ফলে গ্রাহকের আমানতকৃত অর্থ যথাসময়ে ফেরত পাওয়ার অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। এই অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ প্রয়োজন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করার জন্য ব্যাসেল আদর্শ পরিপালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ব্যাংকগুলোর জন্য। ব্যাংকিং কার্যাবলির ক্ষেত্রে কম ঝুঁকিপূণ ইসলামিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম থেকে তা বোঝা যায়।
প্রচলিত ব্যাংক অর্থকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু ইসলামিক ব্যাংক অর্থকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজন উৎপাদনশীল শিল্পের প্রসার। ব্যাংকিং কার্যক্রমের ধারা হিসেবে প্রচলিত ব্যাংকগুলো উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল যে কোনো খাতে ঋণ হিসেবে টাকাকে পণ্য গণ্য করে বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে ঋণের সম্পূর্ণ টাকা ব্যবসায়িক খাতে ব্যবহার নাও হতে পারে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কাম্য মুনাফা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। জাতীয় অর্থনীতিতে এর ফলে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। অন্যদিকে ইসলামিক ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রমের ধারা হিসেবে উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীলসহ যে কোনো শরিয়াহ্সম্মত পণ্য বা সেবা প্রদানের নিমিত্তে টাকাকে পণ্য হিসেবে গণ্য না করে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, যার ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে ডিজিটাল আধুনিক যুগে মাকাসিদ আশ শরিয়াহ্র আলোকে গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
লেখকঃ ড. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা: অফিসার, ইসলামি ব্যাংকিং ডিভিশন, ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড।