বিশেষ কলামব্যাংক শাখা

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত ব্যাংক উপশাখা

মো. জিল্লুর রহমানঃ ব্যাংক খাতকে বলা হয় অর্থনীতির ধারক ও বাহক। কোটি কোটি মানুষের সঞ্চয়ের শেষ ভরসা হলো ব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আর্থিক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক খাত। এ খাতের আওতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ব্যাংক খাতের সার্বিক সেবামান। ব্যাংকিং ব্যবস্থা হচ্ছে আধুনিকায়ন। মানুষ দ্রুত ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় চালিকাশক্তি হলো ব্যাংক খাত। অর্থ গচ্ছিত রাখা, অর্থ লেনদেন করা, বিভিন্ন ধরনের ঋণসেবা প্রদান, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, এসএমই’র উন্নয়নসহ নানা ধরনের কার্যক্রমে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রায় সব ব্যাংকই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত। পাশাপাশি বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোও ছিল সরকারি। অর্থনৈতিক যাবতীয় লেনদেন ছিল এ ব্যাংকগুলোকে ঘিরেই। পরবর্তী সময়ে কিছু সরকারি ব্যাংককে আবার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আশির দশক থেকে অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।

মানুষের দোরগোড়ায় এখন ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক চালু করেছে উপশাখা এবং এরই মধ্যে ২১টি ব্যাংককে উপশাখা চালুর অনুমতি দিয়েছে, আগে যা ব্যাংকিং বুথ নামে পরিচিত ছিল, তাই এখন উপশাখা। এতে কম খরচে ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তৈরি হচ্ছে নতুন গ্রাহক, বাড়ছে আমানত, বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ। ফলে ব্যাংকিং সেবায় নতুন দিগন্ত যুক্ত হয়েছে উপশাখায়। এই উপশাখা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অগ্রগতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকার ও বিশ্লেষকেরা। এর আগে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয়, যা এরই মধ্যে বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। উপশাখাগুলো পরিচালিত হচ্ছে সরাসরি নিকটবর্তী ব্যাংক শাখার অধীনে।

উপশাখা হলো ব্যাংকের শাখার আদলে ছোট পরিসরের ব্যবসাকেন্দ্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষায় উপশাখা হলো সময়ে সময়ে নির্দেশিত নীতি পদ্ধতির আলোকে সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য ব্যাংকের কোনো পূর্ণাঙ্গ শাখার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত স্বল্পব্যয়ী ব্যবসা কেন্দ্র। প্রতিটি উপশাখা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিকটবর্তী কোনো শাখার নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। নিয়ন্ত্রণকারী শাখা থেকে উপশাখার ন্যূনতম দূরত্ব হতে হয় কম-বেশি এক কিলোমিটার। জেলা শহরের বাইরে উপশাখা স্থাপনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী শাখা থেকে নিয়মিত যোগাযোগ, নগদ অর্থের সহজ ও নিরাপদ পরিবহন এবং সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে শাখা থেকে এর দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়। উপশাখা থেকে ব্যাংকের বিদ্যমান এজেন্ট আউটলেটের দূরত্ব মেট্রোপলিটান এলাকার ভেতরে ও বাইরে যথাক্রমে তিন ও পাঁচ কিলোমিটার বজায় রাখতে হয়। উপশাখার ফ্লোর স্পেস হবে অনধিক এক হাজার বর্গফুট এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ন্যূনতম দুজন, সর্বোচ্চ ১০ জন কর্মকর্তা নিযুক্ত হবেন। তারা মূল শাখায় যেসব সেবা প্রদান করা হয়, তার প্রায় সব সেবাই প্রদান করবেন।

কম লোকবল ও সাজসজ্জার কারণে খরচও কম। এর ফলে ব্যাংকগুলো উপশাখা স্থাপনে দিনে দিনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। ব্যাংকের ভল্টের নিরাপত্তার মতো উপশাখার টাকা জমা এবং ক্যাশে থাকা টাকার পূর্ণ বিমা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনে উপশাখায় ভল্ট স্থাপন করা যাবে। এসব ব্যবসা কেন্দ্র চালু করতে হলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উপশাখায় নিরবচ্ছিন্ন ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো থাকতে হবে। কম খরচে আর্থিক সেবার জন্য একটি শাখার অধীনে কাজ করে উপশাখা। এসব উপশাখা থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছাড়া সব ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবমতে, সারাদেশে এরই মধ্যে ২১ ব্যাংকের কয়েকশ উপশাখা চালু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি উপশাখা খুলেছে আইএফআইসি ব্যাংক। ব্যাংকটি সারাদেশে সাত শতাধিক উপশাখা স্থাপন করেছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডও এরই মধ্যে প্রায় ২০০ উপশাখার মাধ্যমে তাদের সেবা সম্প্রসারিত করেছে। এর বাইরে ওয়ান, অগ্রণী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, মিডল্যান্ড, ঢাকা, ট্রাস্ট, শাহজালাল ইসলামী ও ইস্টার্ন ব্যাংকও উপশাখা খুলেছে।

উপশাখা থেকে ব্যাংকিংয়ের প্রায় সব সুবিধাই পাওয়া যাচ্ছে। উপশাখাকে স্বল্পব্যয়ী ব্যাংকিং সেবার আউটলেট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসেবে প্রচলিত শাখা স্থাপনের জন্য নির্ধারিত বিভিন্ন ব্যয়সীমার চেয়ে উপশাখা স্থাপনের ব্যয় এবং প্রচলিত শাখা কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাংকিং সেবার জন্য নির্ধারিত ফি, চার্জ ও কমিশনের চেয়ে ব্যাংকিং বুথে সেবা প্রদানের ফি, চার্জ, কমিশন প্রভৃতি কম ছাড়া বেশি হবে না। উপশাখার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে আর্থিক সেবা ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং স্বল্পব্যয়ী ব্যাংকিং সেবা আউটলেটের মাধ্যমে অধিকতর আর্থিক সেবা ভুক্তি নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সবাইকে ব্যাংকিং সেবায় আনতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর একটি হলো উপশাখা। এর মাধ্যমে একেবারে গ্রামে গিয়ে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা দেয়া যাচ্ছে। সবার ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত হলে দেশ এগিয়ে যাবে এবং যার সুফল পাবে সবাই। দেশের গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, বেসরকারি এবং বিদেশি মিলিয়ে মোট ৬৩টি ব্যাংক ব্যবসায় রত রয়েছে।

একসময় ব্যাংকের ব্যবসা হিসেবে শাখা ব্যাংকিং, কৃষি শাখা, এসএমই শাখা, বুথ (কালেকশন বুথ, ফাস্ট ট্র্যাক, সেবাঘর ও ইলেকট্রনিক বুথ) ও ব্যবসা উন্নয়ন কেন্দ্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্বল্প ব্যয়ে ব্যাংকিং সেবা কীভাবে মানুষের নাগালে পৌঁছানো যায়, তারই আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং বুথ স্থাপন-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। এতে বলা হয়, ব্যাংকিং বুথের আয়তন হবে এক হাজার বর্গফুটের মধ্যে। এর পরই ব্যাংকগুলো বুথ স্থাপন জোরদার করে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার জারির মাধ্যমে মানুষের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ব্যাংকিং বুথকে উপশাখায় রূপান্তর করে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ও আর্থিক সঞ্চালন অনেকটাই যেকোনো দেশের ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভর করে। মানবশরীরে ধমনী দিয়ে যেমন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত প্রবাহিত হয়, তেমনি ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে অর্থের সঞ্চালন ও বিকাশ ঘটে। গ্রাহকদের আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে মজবুত ও শক্তিশালী করে। করোনাকালে ও করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ও আর্থিক কার্যক্রম পুনরুদ্ধারে ব্যাংক খাতের সুসংগঠিত ভূমিকা অনবদ্য ও অনস্বীকার্য। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করোনা-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ও আর্থিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। করোনাকালে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো উপশাখা ব্যাংকিং সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা শুরু হওয়ার পর শাখাগুলোয় গ্রাহকদের উপচে পড়া ভিড় অনেকটা কমে গেছে। গ্রাহকরাও সচ্ছন্দে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারছে। নিঃসন্দেহে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে চলা শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত কৃষক, গার্মেন্ট কর্মী, ব্যাংকার, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সর্বস্তরের পেশাজীবী ও শ্রমিকদের হাত ধরে। তাদের কারণেই সম্ভব হয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। যে বাংলাদেশকে আগে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল, সেই বাংলাদেশকে উন্নয়নের সম্ভাবনা বলে চিহ্নিত করেছেন ব্রিটিশ ও নরওয়ের অর্থনীতিবিদরা।

আরও দেখুন:
ব্যাংক কি বা ব্যাংক কাকে বলে?
বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
ব্যাংকিং কি বা ব্যাংকিং কাকে বলে?

বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি এবং উপশাখা অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের দুয়ার খুলে দিয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যাংকিং সেবায় উপশাখা নতুন দিগন্ত যোগ করেছে।

লেখকঃ মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও মুক্তমনা কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button