ফিনটেক

সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে

কবিতা রাণী মৃধা: যেসব যন্ত্র নেটওয়ার্ক দ্বারা একসঙ্গে যুক্ত থাকে যেমন কম্পিউটার অথবা মোবাইল; এসব যন্ত্র ব্যবহার করে যখন কোনো অপরাধ করা হয় তাকে সাইবার ক্রাইম বলে। যারা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাদের সাইবার অপরাধী বলে। ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল যুগের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটে অপরাধের সংখ্যা আরও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু এ ধরনের অপরাধ যেকোনো দূরবর্তী অবস্থান থেকে করা যেতে পারে উদাহরণস্বরূপ যেকোনো দেশ, তাই বেশিরভাগ অপরাধী সাইবার ক্রাইমকে বেছে নিচ্ছে। কেননা এখানে ধরা পড়বার এবং শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সাধারণত ফিশিং, হ্যাকিং, সাইবার-নির্যাতন, পরিচয় চুরি করা, স্প্যামিং এ ধরনের অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ অনুযায়ী, ফেসবুকে বা কোনো গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারও নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি দিলে, অশালীন কোনো কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু করলে তা সাইবার অপরাধ বলে গণ্য হবে। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে সাইবার অপরাধ হতে পারে। এছাড়া অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তাও সাইবার অপরাধ হবে।

করোনাকালে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখেও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে প্রযুক্তি। আবার এটাও বলা হচ্ছে, করোনা-পরবর্তীকালেও মানুষের ব্যক্তি ও পেশাজীবনকে নতুনভাবে প্রভাবিত করবে প্রযুক্তি। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে এবং বাড়বে, ততই হুমকিতে পড়ছে এবং পড়বে সাইবার নিরাপত্তা। অনলাইনে নানা রকম ফাঁদ পেতে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে বিশ্বজুড়েই। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশেও এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটছে অহরহ।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে সাইবার প্রতারণা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাময়িকীটি বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত দেশগুলোয় অন্যান্য অপরাধের হার তুলনামূলক কম হলেও সাইবার অপরাধের হার ব্যাপকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোর ট্রেড সংস্থা ইউকে ফাইন্যান্সের তথ্যানুযায়ী, গত বছর কর সংগ্রহকারীর নাম উল্লেখপূর্বক ফোন করে প্রতারণার হার যুক্তরাজ্যে দ্বিগুণ হয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

অন্য দেশেও এ ধরনের প্রতারণার হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ক্রাইম সার্ভে অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যে ২০১৯ সালে ৩৮ লাখ অনলাইন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যা দেশটিতে মোট অপরাধের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ সালে দেশটি এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর থেকে প্রতি বছর সাইবার জালিয়াতির ঘটনা বাড়তে দেখেছে। সেখানে প্রায় ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এ জালিয়াতির শিকার হন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি মানুষ এক হাজার ডলারের বেশি অর্থ খুইয়েছেন। যুক্তরাজ্যের মতোই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছর দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণা ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণায় গত বছর মোট লোকসান হয়েছে ৪২০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় তিন গুণ বেশি।

সাময়িকীটি তাদের বিশ্লেষণে আরও বলেছে, নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় অনেক পুরোনো ধাঁচের অপরাধ নতুন করে করতে পারছে দুর্বৃত্তরা। প্রযুক্তি তাদের কাজ আরও সহজ করে দিয়েছে। মাদক পাচারকারীরা ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসেবে বিটকয়েন ব্যবহার করে লেনদেন করছে। তারা অপরাধী চক্রের বিশেষ এনক্রিপটেড নেটওয়ার্ক সফটওয়্যার ব্যবহার করে অপরাধ বাড়িয়েছে।

দেশে সাইবার অপরাধ বেড়েই চলছে। পুলিশের সাইবার ইউনিটের দেয়া তথ্য মতে, প্রতি মাসে তিন হাজার কমপক্ষে সাইবার অপরাধের অভিযোগ হচ্ছে। মামলা হলে জড়িতরা আটকও হচ্ছে। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এ ধরনের অভিযোগ আরও বেড়েছে। নারীদের পাশাপাশি অনেক পুরুষও সেক্সটরশনের শিকার হচ্ছেন। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদাহানি, ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায়? বা অন্য কোনো সুবিধা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। তবে মানসম্মানের ভয়ে অধিকাংশই মামলা না করে প্রতিকার চাইছেন। দেশে সাইবার অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গঠন করা হয় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাংগঠনিক কাঠামোতে যোগ করা হয় ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার’ নামের ইউনিট। এছাড়া গোয়ে?ন্দা পুলিশ (ডিবি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রাশন্যাশনাল ইউনিটের (সিসিটিসি) পৃথক উইং নিয়ে? কাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইন্টেলিজেন্স) মো. রেজাউল মাসুদ বলেন, বর্তমানে আমাদের তিনটি উইং কাজ করছে। সাইবার মনিটরিং ও সাইবার ইন্টেলিজেন্স এবং সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। প্রতি মাসে কমপক্ষে তিন হাজার অভিযোগ আসে। প্রতারণা, হুমকি, হ্যাকিং, পর্নোগ্রাফি আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে? সাইবার ক্রাইম ঘটে চলেছে।

পুলিশের ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাইবার অপরাধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তিন হাজার ৬৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭৫টি মামলা সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টির। ২৫ মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে।

সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট দুই হাজার ৬৪২টি মামলা আসে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২৫৬টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে আসে তিনটি মামলা।

সরাসরি ট্রাইব্যুনালে দায়ের হয়েছে এক হাজার ৮২টি মামলা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২৪৯টি, ২০১৯ সালে ৬৬৮টি এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৬৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। দেখা গেছে, মামলাগুলোর মধ্যে ৪৪৭টি বিভিন্ন সংস্থাকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বাকি ৬৩৫টি মামলায় প্রয়োজনীয় উপাদান না থাকায় আদালত খারিজ করে দেন। তদন্তাধীন ৪৪৭টি মামলার মধ্যে ১৫০টির তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে আদালতে জমা হয়েছে।

ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ৫৯৮টি। মোট আসামি এক হাজার ১৪৭ জন। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হন ৪০৮ জন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ঢাকা মহানগর এলাকায় সাইবার অপরাধে মামলা হয়েছে ২০০টি, ২০২০ সালে ২৬২টি, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (মে পর্যন্ত) মামলা হয়েছে ১৩৬টি।

সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩৫টি মামলার আসামিদের সাজা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮৯টি মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়া অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২০০টিরও বেশি মামলার আসামিরা।

শুধু ব্যক্তি-পর্যায়ে নয়, প্রাতিষ্ঠানিক-পর্যায়েও হয়রানি ও প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। সম্প্রতি উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের (উই) প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশার নাম-পরিচয় ও ছবি ব্যবহার করে ফেক আইডি ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনেক উদ্যোক্তাকে মিথ্যা মেসেজ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১২ লাখ নারী সদস্যের সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করা হয়।

অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতারণা, যৌন হয়রানিসহ আরও অনেক ধরনের অপরাধ বাংলাদেশে আগে থেকেই সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু নতুন ধরনের সাইবার অপরাধ শঙ্কার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব অপরাধের জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে যোগাযোগ রক্ষা করেন অপরাধীরা। শুধু উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী নয়, সাইবার অপরাধের শিকার হন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।

আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকারদের চাকরি সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ
◾ ৩৩১৩ ব্যাংকার ১৯ মাসে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন
◾ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও বাড়লো

বাস্তব জীবনে অনেক অপরাধ যেমন, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ইত্যাদি সব সময়ই ঘটছে। কিন্তু ইন্টারনেটে ৮০ ভাগ অপরাধের ধরন নতুন। তাই ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকতে প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে সচেতন হতে হবে। যন্ত্রপাতি দিয়ে সাইবার অপরাধ ঠেকানো যাবে না। কোনো ধরনের অপরাধ থেকে কীভাবে বাঁচা যায়, সে সম্পর্কে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক নিয়মিত কর্মসূচি দরকার। অনলাইনে উগ্র ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য, অন্তরঙ্গ ভিডিও প্রচারÑএগুলো সার্বিক শিক্ষা এবং রুচিবোধেরই প্রতিফলন। এজন্য ইন্টারনেট সভ্যতা শিখতে হবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button