প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা
মােঃ আমিনুর রহমানঃ কৃতজ্ঞতা একটি মহৎ গুণ। প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশও তেমনি অতি আবশ্যক ও মূল্যবান কর্তব্য। ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান বড়, আর প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এর নীতি আদর্শ বড়। প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির তথা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঠিকানা তথা-পরিচয় দেয়, মর্যাদা দেয়। ব্যক্তিকে কর্মক্ষম রাখাতে ও অভীষ্টমূখী হতে সহায়তা করে। জীবিকা ও জীবনে প্রশান্তি দেয়। প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির জন্য ছায়াবৃক্ষ স্বরুপ। ফলে সর্ব অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা ব্যক্তির বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
কৃতজ্ঞতা বা শােকর হচ্ছে উপকারীর উপকার স্বীকার করা, এমন কর্ম সম্পাদন করা যার মাধ্যমে উপকারীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। শােকর হলাে অনুগ্রহ সম্পর্কে পরিচিতি অর্জন করা ও প্রচার প্রসার করা। শােকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মানব চরিত্রের অমূল্য সম্পদ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যদি তােমরা শােকর আদায় কর তবে আমি নিশ্চয় তােমাদের নিয়ামত বৃদ্ধি করে দিব।’ -সুরা ইব্রাহীম, আয়াত-০৭। মানুষ কারাে উপরে সন্তুষ্ট হয়ে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববােধ সৃষ্টি হয়। সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় শােকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা প্রত্যেকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
চাকুরীজীবিকে প্রতিষ্ঠানে যােগদানের সময় যে যােগদানপত্র দেয়া হয়, সেখানে অনেকগুলাে প্রতিশ্রুতি পালনের অঙ্গীকার করতে হয়। এছাড়াও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের চাকুরীবিধি থাকে সেগুলাে তাকে মেনে চলতে হয়। এগুলাের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অগ্রগতি ও উন্নতির জন্য তিনি কাজ করবেন, নিয়ম-আচার মেনে চলবেন, প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করবেন না এবং প্রতিষ্ঠানের গােপনীয়তা রক্ষা করবেন ইত্যাদি মূখ্য। তদুপরি, চাকুরীজীবি ও নিয়ােগকর্তার মধ্যে কিছু সহজাত দায়িত্ববােধ থাকে, সেগুলােও তাকে মেনে চলতে হয়। এসমস্ত দায়িত্ববােধ চাকুরীজীবির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার এবং এ সমস্ত অঙ্গীকার প্রতিশ্রুতি মেনে চলা তাঁর জন্য আবশ্যক।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ঈমানেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন করে না সে মুনাফিকের কাজ করে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি। যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলবে, যখন প্রতিশ্রুতি করবে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে এবং যখন আমানত রক্ষী হবে তখন তাতে খিয়ানত করবে। -সহীহ বুখারী। মহান আল্লাহ বলেন, “আর সত্যপরায়ণ তারাই যারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করে।” -সুরা বাকারা, আয়াত -১৭৭। রাসুল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি পালন করে না, তার দ্বীন নেই।’ -মুসনাদে আহমাদ: ১১৯৩৫। সুতরাং প্রতিষ্ঠনের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। এটা চুক্তি ভঙ্গজনিত বিশ্বসঘাতকতা। আর “নিশ্চই আল্লাহ চুক্তি ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না।” -সুরা আনফাল, আয়াত: ৫৮। ফলে প্রতিশ্রুতি পালন প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
আমরা চাকুরী জীবনে কর্মে ফাঁকি দেয়ার জন্য অনেক অজুহাত খুঁজি। বলা হয় বাঙালীর তিন হাত, ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত। অজুহাত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যথাযথ কাজ না করে বলে থাকি: -That’s not my Job, I thought some one else was doing it, That’s the way it has always been done, I have been far too busy, I said it would happen, Nobody told me, I could not find it, I left it at home, I thought you know already. I thought it was finished, etc. এ ধরণের নানান অজুহাত কর্মীর দক্ষতাকে নষ্ট করে, উদ্যোগী হতে বাধা দেয় এবং একজন অকৃতজ্ঞ কর্মচারী হতে সহায়তা করে। আসলে জীবন ততদিনের সে যতদিন গৌরব ও মর্যাদার পথে থাকতে পারে। ফলে অজুহাত নয় বরং কর্মদীপ্ত জীবনই আলােকিত মানুষ তৈরি করে। কর্মচাঞ্চল্যবােধ মানুষকে কৃতজ্ঞ হতে উদ্বুদ্ধ করে।
চাকুরী জীবনে বেতন, বােনাস ইত্যাদি যেমন কাজে গতি আনে। আবার অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে, কর্মে শৈথিল্যের বাহানা হিসাবে কাজ করে। তাদের মধ্যে একধরণের বঞ্চিতবােধ কাজ করে। মনে করেন প্রতিষ্ঠান তাদের ঠকাচ্ছে। ভাবেন তাদের সময়ের অনেকে এখন বেশী পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের ভাবা উচিত প্রতিষ্ঠানকে আমরা কতটুকু দেই, আর কতটুকু নেই। যা দেই তার থেকে প্রতিষ্ঠান থেকে নেই অনেক বেশী। একটি প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা সমান দক্ষতা অর্জন করবেন, এমন কথা নেই। তবে ততটুকু দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা থাকা দরকার, যাতে করে তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে যা নেন তার চেয়ে যেন বেশী দিতে পারেন। অনেক কর্মীর Balance Sheet এ সম্পদের থেকে দায় বেশী থাকার পরও প্রতিষ্ঠান কি কার্পণ্য করে? কাজ বােঝেন না। সহকর্মীদের মত কাজে ফলাফল অর্জন করতে পারেন না। কাজের পরিমান কম। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে, উদ্ভাবনে ভূমিকা নেই।
সারাদিন কি করেন তার হিসাব মিলানাে যায় না। আসেন এবং যান অবস্থা। প্রতিষ্ঠানের সম্পদ না হয়ে বােঝা হয়ে উঠেন। অন্যের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত না হয়ে হতাশার কারণ হয়ে পড়েন। আমরা অসুস্থ হই, সাপ্তাহিক ও সাধারণ ছুটি কাটাই। এর পরও বেতন-বােনাস পাই। ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা দরকার। প্রতিষ্ঠানকে ভালবাসা দরকার। প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার মাত্রাটা ভিন্নমাত্রিকও হতে পারে। ত্যাগ করেও কৃতজ্ঞ থাকা যায়। অনেক চাকুরীজীবি আছেন যারা যতদিন কাজ করে ততদিনের বেতন পান। অনেক প্রতিষ্ঠান ত্রিশ দিনই বেতন দেয়। তাছাড়া বেতন-বােনাসই তাে চাকুরীজীবির জন্য সব নয়। প্রতিষ্ঠান তাকে অনেক কিছু দেয়। সেগুলাে উপলদ্ধির বিষয়। ফলে সুখী থাকা ও কৃতজ্ঞ থাকার অনেক রাস্তা থাকে। যেমনটি আমেরিকার লেখক Gerard Arthur Way বলেছেন, ‘Being Happy doesn’t mean everything is perfect. It means that you’ve decided to look beyond the imperfections’, তেমনি কষ্টের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের বদন্যতাকে বুকে ধরে আপনি সবসময় হাসতে পারেন।
কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি কর্মীর কর্মউৎপাদনশীলতায় বেশ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সবাই যেমন পদোন্নতির যােগ্য হন না, তেমনি অনেককে পদোন্নতি প্রদান করাও প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্যর মধ্যে থাকে না। যারা পদোন্নতি পান না তারা অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন না। কেউ কেউ অকৃতজ্ঞ হয়ে কাজ কমিয়ে দেন। এটা আত্নঘাতী কর্ম ছাড়া কিছুই নয়। ম্যানেজমেন্টের গুরু Peter Drucker এর কথাই বলা যাক, তিনি বলেছেন, “Rank does not confer privilege or give power. It imposes responsibility. “সুতরাং দায়িত্ব পালন করুন। আসলে জীবনে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। FAIL (ব্যর্থ) ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। যেমন- F-First, A-Attempt, I-In, L-Learning বা ব্যর্থতা First attempt in learning হতে পারে। ফলে বঞ্চিতরা বুক ভরা আসা নিয়ে কাজ করতে পারি। আসলে ব্যর্থতার জন্য চেষ্টা ত্যাগ করা উচিত নয়। কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে পদোন্নতি শুধুমাত্র কর্মীর অযােগ্যতার কারণেই হয় না বরং প্রতিষ্ঠানের বহুবিধ সীমাবদ্ধতার কারণেও অনেক যােগ্য প্রার্থী পদোন্নতি বঞ্চিত হন।
ফলে পদোন্নতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মূল অনুসঙ্গ হতে পারে না। এজন্য পদোন্নতি না পেলেও প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বঞ্চিতরা ভাবতে পারেন- এটা আমার ব্যর্থতা নয় বরং প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তারা আমার চেয়ে যােগ্য। আমরা আরও আত্নপ্রত্যয়ী হতে পারি এবং তুমুল প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারি। আগামীতে পদোন্নতি হবে এ প্রত্যয়দ্বীপ্ত হয়ে আশা দেখতে পারি। পদোন্নতি বঞ্চিত অথবা বঞ্চিতদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট প্রশমিত করতে পারি। প্রতিষ্ঠানকে আরও ভালবেসে অধিক কাজ করতে পারি। আর এ সুখ অনুভব করতে পারি যে আমার পদোন্নতি না হলেও আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করছে, প্রতিষ্ঠান বড় হচ্ছে। এভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। এটাই মহানুভবতা।
এক্ষেত্রে আমেরিকার লেখক Dave Willis এর কথা মনে করতে পারি। তিনি বলেছেন, “Show respect even to people who don’t deserve it; not as a reflection of their character, but as a reflection of yours.” চাকুরীর ক্ষেত্রে সফলতা শুধু বেতন ও উপাধির উপর নির্ভর করে না। বরং চাকুরীর ক্ষেত্রে সফলতা, উপাধি, খেতাব, বেতন, কি ধরণের কাজ করি, প্রতিষ্ঠানের কর্ম-পরিবেশ, মানসিক স্বাস্থ্য, শারিরিক স্বাস্থ্য, চাকুরীর স্থায়ীত্ব, ভবিষ্যত, প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, দর্শন ইত্যাদি বহুবিধ কারণের উপর নির্ভরশীল। ফলে চাইলে খেতাব ছাড়াই অন্য উপাদান নিয়ে আপনি গর্ব করতে পারেন।
প্রতিষ্ঠান জীবনের নিরাপত্তা দেয়, স্বস্তি দেয়। প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়। চাকুরীর কারণে কর্মকর্তারা জীবনে নিশ্চয়তা অনুভব করে। প্রতিষ্ঠান যে চাকুরীজীবির কত বড় অবলম্বন সেটি বেকারদের জীবন থেকে উপলব্ধি করা যায়। কোন প্রতিষ্ঠান কর্মীর জীবনে যে কত বড় মহিরুহ সেটি অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন। কোন এক বিদায় অনুষ্ঠানে একজন বড় কর্মকর্তা তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন, ‘আমি চাকুরী না করলেও এই প্রতিষ্ঠানকে ভুলতে পারব না। আমি যখন আমার স্ত্রীর পােশাকের দিকে তাকাই তখন বুঝি এই দামী পােশাক প্রতিষ্ঠানের বেতন থেকে কেনা, যখন সন্তানদের দিকে তাকাই তখন ভাবি তাদের লেখাপড়া ও বড় হওয়ার পিছনে চাকুরীর বেতন-বােনাসই মূল উৎস। এভাবে যখন বড় ভাই এর কবরের দেয়ালের দিকে তাকাই তখন বুঝতে পারি প্রতিষ্ঠানের বেতন না পেলে ঐ দেয়াল দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। ফলে আমরা কিভাবে প্রতিষ্ঠানের অবদানকে অস্বীকার করব।’ সত্যিই যথার্থ ও পবিত্র অনুভূতি।
প্রতিষ্ঠান কর্মীর অধিকার ও মৌলিক চাহিদাগুলাে পূরণ করে। কর্মীর জীবনে প্রতিষ্ঠানের মহান অবদানগুলাে ভাবলে সবার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠাই স্বাভাবিক। মানুষের মর্যাদা তার সামাজিক ভূমিকার (Role) উপর নির্ভর করে। যে যত বড় ভূমিকা রাখে সমাজে তার মর্যাদা তত বড়। প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বিভিন্নমুখী ভূমিকা পালনের অপার সুযােগ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানের কারণে তিনি জাতি গঠন, সমাজের উন্নয়ন, ব্যক্তির বহুবিধ কল্যাণ সাধণের সুযােগ পান। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারটির কারণে তিনি যশ, খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করেন। চাকুরীকালীন সময়ে যে কর্মকর্তাটির বক্তব্য খবরের কাগজে ছাপা হয়, ছবি প্রকাশ পায়, রাস্তায়-হাটে অন্যরা সালাম দেন, কিন্তু যখন তার চাকুরী থাকে না তখন তিনি এ সম্মান আর পাননা। অনেকে মন্ত্রী, এমপি, সচিব পদে থাকা কালীন সময় দেশের জন্য অনেক পরিকল্পনা নেন, মানব কল্যাণে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু যখন তার ঐ পদ থাকে না তখন তাঁকে এ ধরণের মহৎ ভূমিকা রাখতে আর দেখা যায় না।
প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও চেয়ার এর কারণেই তিনি কল্যাণে ব্রতী হতে পারেন। ফলে প্রতিষ্ঠানের চাকুরী তাকে উদ্যোগী করে, আস্থাশীল করে ও বিভিন্নমুখী ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করে এবং এর মাধ্যমে সমাজে তার সুনাম সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠা হয়। এ সমস্ত অর্জিত মর্যাদার জন্য প্রত্যেক কর্মীর উচিত প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বন্ধতা থাকা। যেগুলাে তাকে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার এর অজস্র সুযােগ সৃষ্টি করে। চাকুরীকালীন বা চাকুরী শেষেও সেটি অনুভব করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা। ব্যস্ততা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় নেয়ামত। নিজ হাতে কাজ করতে পারা অনেক সৌভাগ্যের। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে হাদিস শরীফে এসেছে ‘ফরজ ইবাদতের পরেই হালাল উপানি ফরজ দায়িত্ব।’ -(তিরমিজি)। হালাল উপার্জন সমূহের মধ্যে সেটি সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রমে অর্জন করা হয়।’- (মুসলিম)। নবী-রাসুলগণ কায়িক পরিশ্রম করেই জীবিকা উপার্জন করেছেন। হযরত নূহ (আঃ) কাঠমিস্ত্রি বা ছুতারের কাজ করেছেন। হযরত ইদ্রিস (আঃ) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হযরত দাউদ (আঃ) কামারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমনকি হযরত শােয়াইব (আঃ) এর খামারে হযরত মুসা (আঃ) দীর্ঘ ০৮ থেকে ১০ বছর কাজ করেছেন।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মা খাদিজা (রাঃ) এর ব্যবসায় সহযােগী হিসাবে চাকুরী করেছেন। ফলে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা অনেক। প্রতিষ্ঠান কর্মীদেরকে এই ‘শ্রম’ দেয়ার সুযােগ করে দেয়। সে কাজ পায়। কর্মীরা এ সুযােগ না পেলে অলসতা ও বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত হতে হতাে। প্রতিষ্ঠান যে পরিশ্রম করার সুযােগ করে দেয়, এজন্য প্রত্যেক কর্মকর্তার শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নজীর হিসাবে স্বীয় কর্তব্য যথাযথভাবে সম্পন্ন করা দরকার। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলাে শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। আর শ্রমিকের কর্মীর দায়িত্ব হচ্ছে দক্ষতা, যােগ্যতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে নিজেকে নিয়ােজিত করা। এটাই বড় কৃতজ্ঞতা।
অফিস আদেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম। একজন কর্মী কি কাজ করবেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হচ্ছে অফিস আদেশ। প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য অফিস আদেশের মাধ্যমে কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। অফিস আদেশ কর্মীর জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বড় আমানত। এটা তার মর্যাদার প্রতীক। প্রতিষ্ঠান তাকে সম্মান করে এবং যােগ্য মনে করে দায়িত্ব দেয়। এ ক্ষেত্রে যাকে যত বেশী কাজ দেয়া হবে প্রতিষ্ঠানের কাছে সে তত যােগ্য ও সম্মানীত। অনেক কর্মী বেশী কাজ দেখে বিরক্ত হন। এটা অকৃতজ্ঞতার লক্ষণ এবং আত্নঘাতী মনােভাব। প্রত্যেক কর্মীর উচিত তার উপর অর্পিত দায়িত্বের বেশী কাজ করা। মূলতঃ একজন কর্মী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবেন এটাই নিয়ােগকর্তার আশা থাকে। সবধরণের কাজ করার মধ্যে একটা আলাদা ধরণের আনন্দবােধ আছে। সফল কর্মীর সেটি অনুভব করা দরকার। প্রতিষ্ঠানের সব কাজকে রপ্ত করতে পারলে, কাজকে ভালবাসলে সফল হওয়া যায়। আর সফল কর্মীরা অনেক বেশী কৃতজ্ঞ হয়। ইংরেজীতে এটি কথা আছে, “Need to do ও Nice to do.” অর্থাৎ প্রয়ােজনটুকু করা ও প্রয়ােজনের অতিরিক্ত করা। প্রত্যেক কর্মীর উচিত প্রয়ােজনের অতিরিক্তটাই করা। প্রতিষ্ঠানের প্রতি এটাই যথার্থ কৃতজ্ঞতা।
চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা ও যােগ্যতা অর্জন প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বড় নজির হতে পারে। প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে চালনার জন্য যথাযথ তাত্ত্বিক জ্ঞান, পরিচালনাগত জ্ঞান ও টেকনােলঞ্জিক্যাল জ্ঞান প্রয়ােজন হয়। কর্মীদের নিজ দায়িত্বে কাম্য জ্ঞান অর্জন করা দরকার। প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রফেশনাল ডিগ্রী অর্জন, বিভিন্ন পেশাগত সার্টিফিকেট অর্জন কর্মীর জন্য যেমন প্রয়ােজন, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য এমন কর্ম তেমন উপযােগী। দক্ষ জনশক্তি দেশের সম্পদ, আর দক্ষতা নিজের সম্পদ। ফলে দক্ষতা অর্জনের জন্য কর্মীর নিজস্ব উদ্যোগ থাকা চাই। প্রতিষ্ঠানের ট্রেনিং এর অপেক্ষা না করে নিজস্ব উদ্যোগে ট্রেনিং গ্রহণ এখন সময়ের দাবী।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য শুধু দৈনন্দিন কিছু রুটিন কাজ করাই যথেষ্ট নয়। বরং আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ মােকাবেলা করার জন্য দক্ষতা ও যােগ্যতা অর্জনও জরুরী। এ জন্য পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও সততা অর্জন, কর্তব্যনিষ্ঠা ও শৃঙ্খলাবােধ সৃষ্টি, সমন্বয় ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতা, উপস্থাপন দক্ষতা, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতার চর্চা, প্রতিষ্ঠানের বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, প্রতিষ্ঠানের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা, সহকর্মী ও সেবা গ্রহীতার সঙ্গে সু-আচরণ প্রদর্শন, প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়নে আগ্রহ ও তথ্যের গােপনীয়তা রক্ষা, সােস্যাল মিডিয়ার সঠিক ব্যবহার, অভিযােগ প্রতিকারে উদ্যোগী হওয়া সহ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ধার্যকৃত অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করার মাধ্যমে তিনি যােগ্য ও কৃতজ্ঞ কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ন হতে পারেন।
তদুপরি নিম্নের দক্ষতাগুলাে অর্জন করে নিগূঢ় সাফল্যকে স্পর্শ করা সম্ভব। যথা-
১. Accept challenges,
২. Be Ambitious,
৩. Be Creative,
৪. Communicate clearly,
৫. Keep Commitments,
৬. Be Courageous,
৭. Have a decision-making power,
৮. Put best efforts,
৯. Focus on Thinks,
১০. Be Forward looking,
১১. Be Goal Oriented,
১২. Show gratitude,
১৩. Be Humble,
১৪. Be Strong
১৫. Be Open,
১৬. Stay Positive,
১৭. Be Productive,
১৮.Be the Leader,
১৯. Be a Quick Thinker,
২০. Be Reliable,
২১. Be Sincere,
২২. Have Self-Confidence,
২৩. Be Supportive,
২৪. Always stay Hopeful.
প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন দক্ষতা ও যােগ্যতা অর্জনের অদম্য চেষ্টা থাকা দরকার।
জাগতিক যত বিষয় আছে তাতে ‘কানাআত’ বা অল্পে তুষ্টি মানুষের নৈতিক গুণ। অল্পে তুষ্টির বিপরীত হলাে লােভ ও মােহ। হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) আপন ছেলেকে এই বলে উপদেশ দিয়েছেন যে, “বাবা শােন! যখন কোন কিছু তালাশ করবে তখন অল্পে তুষ্টি সাথে নিয়ে তালাশ করবে। আর তােমার যদি অল্পে তুষ্টি না থাকে, তাহলে কোন সম্পদই তােমার কাজে আসবে না।” -(আল মুজালাসাতু ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম)।
রাসুল (সাঃ) হযরত আবুজর (রাঃ) কে বললেন, আবুজর! তুমি কি সম্পদের প্রাচুর্যকেই সচ্ছলতা মনে করাে? হযরত আবুজর (রাঃ) বললেন, হ্যা ইয়া রাসুলুল্লাহ। রাসুল (সাঃ) এর পর বললেন, তাহলে তুমি সম্পদের সচ্ছলতাকে দারিদ্র্য মনে করাে? তিনি বললেন হ্যা, রাসুল (সাঃ) অতঃপর বললেন, “আসলে সচ্ছলতা-তাে হৃদয়ের সচ্ছলতাই, আর হৃদয়ের দারিদ্র্যই হল আসল দারিদ্র্য।’ -ইবনে হিব্বান: ৬৮৫। ফলে জাগতিক বিষয় সমূহের ক্ষেত্রে অল্পে তুষ্টি থাকা, অপর পক্ষে দ্বীন, ইমান ও নেক আমলের ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতা করা বুদ্ধিমানের কাজ। মানুষের মধ্যে অন্তহীন স্বপ্ন, তার কোন শেষ নেই। অল্পে তুষ্টি প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সহায়ক হতে পারে।
ইসলাম মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উৎসাহিত করেছে। পক্ষান্তরে, নিরাশা ও হাতাশাকে নিরুৎসাহিত করে। মূলতঃ হতাশা ও নিরাশা হলাে শয়তানের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তােমরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ােনা।” -সুরা যুমার, আয়াত: ৫৩। আশার কারণে মানুষ কাজ করে, কথা বলে, পথ চলে। আশা মানুষের শারীরিক ও মানসিক শক্তির চাকাকে সচল রাখে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে আশা না থাকলে হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত ও ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়। ফলে আশা সফলতার মূল চাবিকাঠি।
আমেরিকার বিখ্যাত সাংবাদিক Norman Cousins বলেছেন, “Death is not the greatest loss in life, The greatest loss is what dies inside us while we live.” ফলে উচ্চাকাঙ্খাকে মেরে ফেলা যাবে না। যে সমস্ত কর্মী আশাবাদী, তারা প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন এবং যথার্থভাবে কৃতকর্ম সম্পন্ন করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। রিজিক অর্থ শুধু খাদ্য সামগ্রী বা টাকা পয়সা নয়, বরং জীবন উপকরণের সবকিছু যথা- মান-ইজ্জত, জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রতিভা, দক্ষতা, সন্তান-সন্ততি, ভাল চাকুরী ইত্যাদি সবই রিজিক।
রিজিক কেন কম বেশী হয়? আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহ তায়ালা যদি তার সব বান্দাহকে প্রচুর রিজিক দিতেন, তাহলে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করত। কিন্তু তিনি যে পরিমান ইচ্ছা (রিজিক) সে পরিমান অবতীর্ন করেন।” -সুরা আশ-শূরা, আয়াত -২৭। আল্লাহ আরও বলেন, “তারা কি তােমার পালনকর্তার অনুগ্রহ বন্টন করে? (না, বরং) আমিই তাদের মধ্যে পার্থিব জীবনে রিজিক বণ্টন করি এবং তাদের একজনের মর্যাদা অপরজনের ওপরে উন্নত করেছি , যেন তারা একে অন্যকে সেবক রূপে গ্রহণ করতে পারে।” -সুরা জুখরুখ, আয়াত: ৩২।
আল্লাহ যেমন রিজিকদাতা তেমনিভাবে রিজিক অন্বেষণ করারও নির্দেশ দিয়েছেন। কাজ করতে হবে। কর্মের মাধ্যমে রিজিক খুঁজে বের করতে হবে। পদ-পদবী, ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টার পরও কাঙিক্ষত বস্তু অর্জিত না হলে আক্ষেপ না করে মনে করতে হবে আল্লাহ চাননি তাই হয়নি। এভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মানুষ জীবনে যা যা ভােগ বা উপভােগ করে সবই তার রিজিক। হালাল রিজিক ইবাদত কবুলের অন্যতম প্রধান শর্ত। হালাল উপার্জন অন্যতম ফরজ ইবাদত।
আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তােমরা হালাল উত্তম রিজিক আহার কর, যা আমি তােমাদের দিয়েছি।” -সুরা বাকারা, আয়াত -১৭২। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি স্বহস্তে পরিশ্রম করে হালাল রিজিক আহরণ করল তার জন্য জান্নাতের দরজাগুলাে খােলা থাকবে।” তিনি আরাে বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বহস্তে পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করল, কিয়ামতের দিন সে নবীগণের সংগে শামিল হবে এবং অনুরূপ পুণ্য লাভ করবে।’ -জামিউল আখবার: ১০৮৭, ১০৮৮। হালাল রিজিক ও সৎ উপনের সব প্রচেষ্টাই ইবাদত। শ্রমিক তার মনিবকে ফাঁকি দিলে তার উপার্জন হালাল হবে না। মনিব তার শ্রমিককে ঠকালে, ন্যায্য পাওনা না দিলে তার সম্পদ হালাল হবে না। ফলে চাকুরীজিবীর দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানাে। সর্ব অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং রিজিক হালালের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা। আমীন।
লেখকঃ মােঃ আমিনুর রহমান। দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে কর্মরত।
Vai kare tel dilen? Nije re, na bank re, na boss re?