ব্যাংকের সুদের কি কোনো বিকল্প নেই?
রিবা বা সুদ যখন সমাজ থেকে উঠিয়ে দেয়া হয়, তখন সে সমাজে প্রকৃত বাজারে বিনিয়োগ বেড়ে যায়। মানুষ সেখানে সরাসরি কৃষি বা অন্যান্য জায়গায় বিনিয়োগ করে থাকে। তখন সেটার সুফল সমাজের প্রতিটি মানুষ পেতে থাকেন বা ভোগ করতে থাকেন। এখন প্রশ্ন থাকে যে, যখন আমরা সমাজ থেকে রিবা বা সুদ উঠিয়ে দিচ্ছি তখন সুদ ছাড়া বিকল্প কি আছে? এই প্রশ্নটা আমাদের কাছে প্রায়ই আসে? অনেক ভাই প্রশ্ন করেন, যখন সুদ আর থাকছে না তখন আমরা ব্যবসা কিভাবে করব? আমরা ব্যাংকের কাছে কিভাবে যাব? ব্যাংক আমাদেরকে কিভাবে সুদ ছাড়া বিনিয়োগ দিবে? আর অন্যদের সাথেই বা কিভাবে আমরা সুদ ছাড়া ব্যবসা করব?
আরও দেখুন:
◾ ইসলামী ব্যাংকিং এর ইতিহাস
ব্যাংকের সুদের বিকল্প হিসেবে আজকে আমরা আলোচনা করব মুশারাকা নিয়ে। মুশারাকা হচ্ছে একটা পার্টনারশিপ চুক্তি বা যৌথ ব্যবসায়িক চুক্তি। যে চুক্তিতে একাধিক ব্যক্তি বা একাধিক পক্ষ একত্রিত হয়ে এক সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। এটা সুদ থেকে বাঁচার চমৎকার একটা বিকল্প হতে পারে। আমরা যখন কোন একটা ব্যবসা শুরু করতে চাই, তখন আমাদের প্রথমেই যেটা প্রয়োজন হয় সেটা হচ্ছে বিনিয়োগ বা মূলধন। আর সে মূলধন যেহেতু আমাদের কাছে থাকে না তখন আমরা ব্যাংকের বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিকট দ্বারস্থ হই। অথবা পরিচিত কারো দ্বারস্থ হই এই চুক্তিতে যে, তারা আমাদেরকে যখন নির্দিষ্ট একটি অংক দেবে তার বিপরীতে আমরা একটি নির্দিষ্ট লাভ দেবো।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ধরুন, কেউ আমাদেরকে এক লক্ষ টাকা দিচ্ছে। তাকে ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ এক লক্ষ টাকার ১০% হিসেবে ১০,০০০ টাকা সহ ১,১০,০০০ টাকা তাকে ফেরত দেব। আর এটাই সুদ। এখন এটা যখন নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের কাছে বিকল্প কি থাকছে? এটা নিয়েই আজকে আমরা আলোচনা করব। আর এই পদ্ধতি বা মোডটির নাম হচ্ছে মুশারাকা। মুশারাকা হচ্ছে একটা পার্টনারশীপ চুক্তি বা যৌথ ব্যবসার চুক্তি বা অংশীদারিত্ব চুক্তি। যেখানে কমপক্ষে দুটি পক্ষ থাকবে। দুটির চেয়ে বেশিও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে দুটি পক্ষ হতে পারে, দুটি প্রতিষ্ঠান হতে পারে আবার দুই বা ততোধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। এখানে প্রতিটি পক্ষ বা ব্যক্তি সাধারণত মূলধন বিনিয়োগ করে থাকবেন সেটা যেকোন রেশিও হতে পারে।
যেমন ধরুন, দুজন ব্যক্তি মিলে একটি ব্যবসা পরিচালনা করবেন যেখানে মূলধন প্রয়োজন ৫ লক্ষ টাকা। এক ব্যক্তি সেখানে দিলেন আড়াই লক্ষ টাকা আরেকজন দিলেন আড়াই লক্ষ টাকা। দুই ব্যক্তি মূলধন দেয়ার পর সেখানে দুজন মিলেই ব্যবসা পরিচালনা করবেন অথবা কথা থাকল এভাবে যে, একজন ব্যবসা পরিচালনা করবেন আর একজন ব্যবসা পরিচালনা করবেন না। তিনি শুধু মূলধন বিনিয়োগ করবেন। এক্ষেত্রে পরিভাষায় যিনি মূলধন বিনিয়োগ করবেন তাকে আমরা স্লিপিং পার্টনার বলে থাকি। অর্থাৎ এমন অংশীদার যিনি ব্যবসা পরিচালনার কাজে সরাসরি কোনো অংশগ্রহণ করবেন না। আরেকজন থাকবেন যাকে আমরা বলি ম্যানেজিং পার্টনার বা ব্যবস্থাপক অংশীদার। যিনি শুধু মূলধন বিনিয়োগ করে নয় বরং সেই ব্যবসা পরিচালনার কাজ করেও অংশীদারিত্বের দায়িত্ব পালন করবেন।
এই যে দুই ধরনের পার্টনার আমরা পেলাম অর্থাৎ স্লিপিং পার্টনার ও ম্যানেজিং পার্টনার এই দুইজন ২ লক্ষ ৫০ হাজার করে মূলধন বিনিয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে তারা যদি দুজনেই ব্যবসা দেখাশুনা করতেন তাহলে লাভের হার ৫০% – ৫০% করে বন্টিত হতো। যেহেতু তারা সমান মূলধন বিনিয়োগ করলেন এবং একজন ব্যবসা দেখাশুনা করবেন তাহলে এক্ষেত্রে প্রফিট বা লাভ কিভাবে বন্টিত হবে? লাভ বন্টন করার নিয়ম হচ্ছে তাদের ব্যবসা থেকে যে আয় হবে সে আয় থেকে খরচ বাদ দেয়ার পর যা থাকে ওই প্রফিটের নির্দিষ্ট হার অনুযায়ী তাদের মধ্যে বন্টন হবে।
এটা যে কোন হার হতে পারে। যেহেতু এক পক্ষ ব্যবসা ম্যানেজ করছেন আরেক পক্ষ শুধু মূলধন দিচ্ছেন। কাজেই ম্যানেজিং পার্টনার যিনি ব্যবসা ব্যবস্থাপনা করছেন তার প্রফিটের হার আরো বেশি হতে পারে অর্থাৎ তিনি ৫০% মূলধন দিয়েছেন তার প্রফিট এর হার ৬০% হতে পারে এতে কোন সমস্যা নেই। এখন যদি প্রফিট এর হার এ ভাবে ভাগ করা হয় ব্যবসা থেকে যা আয় হবে ওই আয় এর ৫০% তাহলে সেটা সহিহ বা বিশুদ্ধ হবে না। ধরুন, রাশেদ যিনি আড়াই লক্ষ টাকা মূলধন বিনিয়োগ করেছেন তিনি ৫০% আর বাকি ৫০% হচ্ছে খালেদ যিনি ম্যানেজিং পার্টনার বিনিয়োগ করেছেন এমনটা যদি করা হয়ে থাকে সেটা জায়েজ হবে না।
কারণ যখন আয়ের ৫০% বলা হচ্ছে তখন কিন্তু গ্রস রেভিনিউ থেকে খরচ বাদ দেয়া হয়নি। ধরুন, আয় থেকেই সরাসরি রাশেদ বা প্রথম ব্যক্তিকে লাভের একটা অংশ দিয়ে দিলাম বাকি যে অংশটুকু সেটা হয়তো পুরা খরচ নির্বাহ করার মতো অবশিষ্ট থাকবে না। তখন সেখান থেকে খরচ বাদ দেয়ার পরে হয়তো এমন হতে পারে যে, একজন পার্টনার যিনি লাভের কোন অংশই পাবেন না। যেহেতু এটা একটা মুশারাকা অংশীদারিত্ব ব্যবসা তাই এখানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মুনাফা বন্টিত হবে। আর এখানে যেহেতু লাভের ক্ষেত্রে একপক্ষ আরেক পক্ষের কাছ থেকে লাভের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে তাই এ ধরনের শর্ত আরোপ করা যাবে না।
একইভাবে যদি এ রকম বলা হয় যে, ক্যাপিটাল বা মূলধনের ১০% দেয়া হবে সেটাও কিন্তু জায়েজ হবে না। কেননা এটাও কিন্তু প্রফিটের অংশ নয়। এ ক্ষেত্রে মূলধন এর ১০% বলা আর ২৫,০০০ টাকা অর্থাৎ আড়াই লক্ষ টাকার ১০% হিসেবে ২৫,০০০ টাকা বলা অর্থাৎ ফ্ল্যাট রেট হিসেবে বলা একই হচ্ছে। এক্ষেত্রে এটা ফিক্সট রেট হয়ে যাচ্ছে। আর ফিক্সট হওয়ার কারণে এটা রিবা বা সুদ হয়ে যাবে। কাজেই এখানে আমাদের একটাই উপায় বাকি থাকল সেটা হচ্ছে লাভের রেশিও বা লাভের হার নির্ধারণ করা। আর লাভ বলা হয় আয় থেকে সকল প্রকার খরচ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে লস কিভাবে নির্ধারণ করা হবে? আমরা এই উদাহরণটিতে ভিন্নভাবে একটি সিনারিও কল্পনা করি যে, রাশেদ এবং খালেদ আড়াই লক্ষ টাকা করে না দিয়ে বরং ধরুন, রাশেদ ২ লক্ষ টাকা দিয়েছে আর খালেদ ৩ লক্ষ টাকা দিয়ে মূলধন ৫ লক্ষ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ রাশেদের মূলধনের অংশ হচ্ছে ৪০% আর খালেদের মূলধনের অংশ হচ্ছে ৬০%। রাশেদ সেখানে ম্যানেজিং পার্টনার বা ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছে এজন্য আমরা তাকে আরো ১০% প্রফিট বেশি দিচ্ছি। অর্থাৎ তার মূলধনের আনুপাতিক হার হচ্ছে ৪০% এবং আমরা তাকে আরো ১০% বাড়িয়ে ৫০% প্রফিট দিচ্ছি। আর খালেদ ৬০% বিনিয়োগ করেছে কিন্তু আমরা তাকে ৫০% প্রফিট দিচ্ছি যেহেতু সে এ ব্যবসায় কাজ করছে না। যদি ৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগের পর ১ লক্ষ টাকা লাভ হয় সেখানে আমরা ৫০% – ৫০% হিসেব অনুযায়ী দুইজনের মধ্যে ৫০,০০০ ও ৫০,০০০ টাকা করে প্রফিট ভাগ করে দিলাম এটা খুবই সুস্পষ্ট বিষয়।
এই অবস্থায় এখন যদি তাদের লস হয় তাহলে কি হবে? আমাদের মাঝে অনেকেই ভুল করে থাকি যেহেতু প্রফিট দেয়া হচ্ছে ৫০% কাজেই লস ৫০% বহন করতে হবে অর্থাৎ ৫০% লস বহন করবেন রাশেদ এবং ৫০% লস বহন করবেন খালেদ। কিন্তু এই বিষয়টা সঠিক নয়। সঠিক বিষয় যেটা সেটা হচ্ছে, লস সব সময় মূলধন এর রেশিও অনুযায়ী ভাগ হয়ে থাকে। কাজেই এই ক্ষেত্রে যদি ১ লক্ষ টাকা লস হয়ে যায় তাহলে যদিও প্রফিট ৫০% হিসেবে ভাগ করার কথা ছিল কিন্তু ক্যাপিটাল বা মূলধন যেহেতু ৪০% – ৬০% ছিল কাজেই ৪০% লস বহন করতে হবে রাশেদকে আর ৬০% লস বহন করতে হবে খালেদকে।
এখন রাশেদ যদি এ রকম শর্ত দিয়ে দেয় যে, আমি লস বহন করব না তাহলে সেটাও জায়েজ হবে না। আবার রাশেদ যদি বলে আমি ৫০% লস বহন করব তুমি ৫০% পার্সেন্ট বহন করব সেটাও জায়েয হবে না বরং সে শর্ত বাতিল হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় লস মূলধনের আনুপাতিক হারে বহন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, ম্যানেজিং পার্টনার এর কোন অবহেলায় যদি লস হয় এক্ষেত্রে যতটুকু ম্যানেজিং পার্টনার এর কারণে লস বা ক্ষতি হয়েছে তাকে ততটুকু লস বহন করতে হবে। এছাড়া অন্য যে কোনভাবে যদি লস বা ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে মূলধনের রেশিও অনুসারে লস পার্টনার এর মধ্যে বন্টন করতে হবে।
লেখকঃ মুফতি মাওলানা ইঊসুফ সুলতান, পিএইচ.ডি। আইএফ একাডেমি এন্ড কন্সালটেন্সি-এর কো-ফাউন্ডার, ক্যান্ডিডেট এন্ড রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন ইন ইসলামিক ফাইন্যান্স (INCEIF) এবং ইথিস ভেঞ্চারস, মালয়েশিয়া-এর শরিয়াহ টেক-কনসাল্টেন্ট। অনুলিখনঃ তাসনিয়া তাবাসসুম।