এজেন্ট ও উপশাখা ব্যাংকিং অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়বে
জালাল উদ্দিন ওমরঃ ব্যাংক হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি এবং নিয়ন্ত্রক। ব্যাংকের অবস্থা ভালো হলে অর্থনীতির অবস্থাও ভালো হয় এবং ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হলে অর্থনীতির অবস্থাও খারাপ হয়। অর্থনীতির অবস্থা ভালো হলে ব্যাংকের অবস্থা ভালো হয় এবং অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হলে ব্যাংকের অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। ব্যাংক এবং দেশের অর্থনীতি পরস্পর নির্ভরশীল। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়নসহ আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পুরোটাই ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং দেশের অর্থনীতির বিকাশের স্বার্থে ব্যাংকিং ব্যবস্থারও বিকাশ ঘটাতে হবে।
একইভাবে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে ব্যাংকিং সেক্টরেরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ব্যাংক মূলত একটি আর্থিক সেবা প্রধানকারী ও আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান। এটি জনগণের টাকা আমানত হিসেবে গ্রহণ করে এবং সেই টাকা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ হিসেবে প্রদান করে। উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা দিয়ে ব্যবসা করেন, শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন এবং আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সম্পাদন করেন। এভাবে সচল থাকে অর্থনীতির চাকা এবং দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যায়।
ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতারা, ঋণের বিপরীতে ব্যাংককে দেয় সুদ। আদায়কৃত সুদের একটি অংশ ব্যাংক তার আমানতকারীদের দিয়ে থাকে। ঋণ থেকে আদায়কৃত সুদের হার সবসময় বেশি হয় এবং আমানতকারীদের দেয়া সুদের হার সবসময় হয় কম। এই দুই সুদের হারের ব্যবধানকে ‘স্প্রেড’ বলা হয়, যা দিয়ে ব্যাংক তার স্টাফ স্যালারি, অফিস ভাড়াসহ যাবতীয় খরচ বহন এবং তারপর মুনাফা অর্জন করে।
ব্যাংক যেহেতু জনগণের টাকাই আমানত হিসেবে গ্রহণ করে এবং সেই টাকাই উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিনিয়োগ করে, সেহেতু ব্যাংকের কাছে ডিপোজিট খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে ব্যাংকের ডিপোজিট বেশি, সেই ব্যাংকই বেশি ঋণ বিতরণ করতে পারে। ফলে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে সেই ব্যাংকের ভূমিকা বেশি। একইভাবে যেই ব্যাংকের ডিপোজিট কম, সেই ব্যাংকের ঋণ বিতরণও কম। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক ঋণ যেহেতু অপরিহার্য, সেহেতু ডিপোজিট কালেকশনটাও ব্যাংকের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
বর্তমানে উপজেলা পর্যায়েও বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে চালু হওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখা ব্যাংকিং এই সেক্টরে নতুন গতি আনছে। ব্যাংকিং সেক্টরের এবং একই সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। জনগণকে ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় আনা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। একইভাবে গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এটি অনন্য ভূমিকা রাখবে। উপজেলা পর্যায়ে ব্যাংকের শাখা থাকলেও তা সাধারণত উপজেলা হেড কোয়ার্টারে অথবা উপজেলার প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে করা হয়।
ফলে ওই উপজেলার দূরবর্তী অঞ্চলের লোকজন ব্যাংকিংসুবিধা থেকে হয় বঞ্চিত। ওই সব এলাকার লোকজনের ডিপোজিট সংগ্রহ থেকেও ব্যাংক বঞ্চিত থাকে। কারণ ১৫-২০ কিলোমিটার দূর থেকে ব্যাংকে যাওয়া সবসময় সব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে ব্যাংকের ডিপোজিট কম হয়। এতে ঋণ বিতরণের পরিমাণও কমে যায় এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও কম হয়। বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত হয় এবং ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের বাইরেই থেকে যায়। ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে রয়ে গেছে। আর এ সমস্যা সমাধানে এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখা ব্যাংকিং অনন্য ভূমিকা পালন করবে।
এ দুটির কার্যক্রমই ব্যাংকের মূল শাখার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। উপশাখা ব্যাংকিং সরাসরি ব্যাংকেরই একটি ছোট ইউনিট যেটি ব্যাংকের মূল ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানকার অফিস ভাড়া, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ইউটিলিটি সবই ব্যাংকের অধিভুক্ত। অর্থাৎ উপশাখাটি ব্যাংকের মূল শাখার মতোই একটি শাখা, তবে আকার ও কার্যক্রমে মূল শাখাটির চেয়ে ছোট। একটি উপজেলায় প্রধান বাণিজ্যিক এলাকায় মূলত ব্যাংকের প্রধান শাখাটি থাকে। এই শাখা ওই উপজেলার সব এলাকার মানুষকে সেবা দিতে পারে না।
অথচ ওই উপজেলায় আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা রয়েছে। এসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মূল শাখার তত্ত্ব¡াবধানে একটি ছোট শাখার কার্যক্রম পরিচালনাকে ‘উপশাখা ব্যাংকিং’ বলা হয়। এর মাধ্যমে ওই এলাকার লোকজন ব্যাংকিং শাখার আওতায় আসে। তারা ব্যাংকে টাকা ডিপোজিট করছে, উপশাখাটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স গ্রহণ করছে। এভাবে উপশাখার মাধ্যমে লোকজন ব্যাংকিং সেবা পেল, ব্যাংক তার সেবার পরিধি বাড়াল এবং ব্যাংকের ডিপোজিট ও আর্থিক খাতে জনগণের অন্তর্ভুক্তি বাড়ল। এতে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে।
অপর দিকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম ব্যাংকের বাইরের একটি পক্ষ দ্বারা পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠান কোনো একটি এলাকায় ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যাংকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকে। এর আওতায় প্রতিষ্ঠানটি নির্দিষ্ট শর্তের বিনিময়ে ওই এজেন্ট হিসেবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। অফিস ভাড়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন এবং ইউটিলিটিসহ যাবতীয় খরচ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান বহন করে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যাবতীয় টেকনিক্যাল ও লজিস্টিক সাপোর্ট এজেন্ট ব্যাংককে দিয়ে থাকে।
এজেন্ট ব্যাংকিং শাখাগুলো ব্যাংকের মূল শাখায় তত্ত্বাবধানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার বিনিময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের মূল শাখা থেকে কমিশন বা সার্ভিস চার্জ আদায় করে এবং এটাই এজেন্ট ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষের আয়ের উৎস। এভাবে কোনো একটি এলাকায় এজেন্ট ব্যাংক স্থাপনের ফলে জনগণ ব্যাংকিং সুবিধা পেল, জনগণ ব্যাংকের আওতায় এলো এবং এর মাধ্যমে তাদের অর্থ দেশের মূল অর্থনীতিতে সংযুক্ত হলো। ফলে বৃদ্ধি পেল দেশের অর্থনীতির কলেবর।
এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখা ব্যাংকিং দেশের ব্যাংকিং সেক্টর এবং অর্থনৈতিক সেক্টরে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আসে। জনগণ এখন এজেন্ট ব্যাংকিং শাখায় এবং উপশাখায় টাকা জমা করছে আর তাদের জমাকৃত অর্থে ব্যাংকের ডিপোজিট বাড়ছে। ফলে দেশের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে, নতুন নতুন কারখানা স্থাপিত হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং দেশের অর্থনীতি হবে গতিশীল।
প্রধানমন্ত্রী গ্রামকে শহরে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আর গ্রামকে যদি শহরে পরিণত করতে হয়, তাহলে গ্রামের অর্থনীতিকে উন্নত এবং শক্তিশালী করতে হবে। গ্রামকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র বানাতে হবে। এ জন্য প্রথমেই কৃষিভিত্তিক শিল্পকে সমৃদ্ধ করা ছাড়াও গ্রামের প্রতিটি জমিতে চাষাবাদ এবং পোলট্রি ও ডেইরি শিল্প স্থাপন করতে হবে। ঘরে ঘরে গরু, ছাগল পালন করতে হবে। প্রতিটি পুকুরে মাছ চাষ করতে হবে। তার জন্য কৃষককে প্রয়োজনীয় ঋণ দিতে হবে।
ক্ষুদ্র আর মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি, বড় শিল্প-কারখানাও স্থাপন করতে হবে। এ জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখাগুলোকে বিনিয়োগ করতে হবে এবং এ জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। শুধু ডিপোজিট কালেকশন ও রেমিট্যান্স প্রদানে এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। গ্রামের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা হলে বেকার সমস্যা দূরীভূত হবে। গ্রাম থেকে শহর অভিমুখী জনস্্েরাত কমবে। ফলে বড় শহরগুলোর ওপর চাপ কমবে, আবাসিক সমস্যা সমাধান হবে এবং যানজটও কমবে। গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমে শহরেরও উন্নয়ন হবে এবং সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। মূল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখা ব্যাংকিং বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে দেশের সব এলাকার সব মানুষই ব্যাংকিং চ্যানেলের আওতায় আসবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়বে। এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখা ব্যাংকিংয়ের সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। জনগণের এই টাকা বিনিয়োগ বা ঋণের নামে কোনো লুটেরার পকেটে যেন ঢুকে না পড়ে, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মনিটরিং বাড়াতে হবে।
অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাচার করেছে এবং তারা বিদেশে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছে। সেই ঋণ অনাদায়ী থাকায় খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ অবস্থায় এজেন্ট ব্যাংকিং এবং উপশাখা ব্যাংকিংয়ের মহৎ কাজকে কেউ যেন ব্যাহত করতে না পারে, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। কর্তৃপক্ষের মনিটরিং, সুপারভাইজিং এবং কন্ট্রোলিং বাড়াতে হবে। মোট কথা, এজেন্ট এবং উপশাখা ব্যাংকিং আরো জোরদার করতে হবে।
লেখকঃ জালাল উদ্দিন ওমর, প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।