একজন ব্যাংকারের করোনা পজিটিভ-নেগেটিভ এর গল্প
যোগ-বিয়োগ চিহ্ন দুইটা সর্বপ্রথম কার কাছ থেকে শিখেছি ঠিক মনে নেই। তবে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়াতে প্লাস-মাইনাস কিংবা পজিটিভ-নেগেটিভ শব্দ দুইটা বরাবরই মজার ছিল আমার কাছে। হাইয়ার সেকেন্ডারিতে হানিফ স্যারের কেমেস্ট্রি ক্লাসে ইলেকট্রন-প্রোটনের পজিটিভ-নেগেটিভ পোল নিয়ে ভালই খেলা করেছি। তারপর ব্যাংকিং পেশা জীবনে শুরু হলো ডেবিট-ক্রেডিটের খেলা। আর এখন ২০২০ সালের এই পৃথিবীতে করোনা নামক একটা অনুজীব পুরনো সেই পজিটিভ-নেগেটিভ নিয়ে নতুন এক খেলা দেখাচ্ছে। সেই খেলায় পজিটিভ হিসেবে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ি জুনের ৫ তারিখ থেকে। এই খেলায় পজিটিভ মানে মহা খারাপ আর নেগেটিভ মানে মহা ভাল। এই পজিটিভ-নেগেটিভ মুহুর্তের মধ্যে একটা মানুষের শরীর ও মনে যে কি পরিবর্তন নিয়ে আসে নিজে আক্রান্ত না হলে সেটা হয়তবা কোনদিন ই বুঝতে পারতাম না।
৫ জুলাই, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ। আমার তৃতীয়বারের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে আমি করোনা নেগেটিভ। এই নেগেটিভ শব্দটা আজ আমার জীবনে যে কত গুরুত্বপূর্ন তা কেবল আমি ই জানি। করোনার সাথে কাটানো আমার দীর্ঘ এক মাসের ফর্মুলাঃ পজিটিভ+পজিটিভ=নেগেটিভ। এই ফর্মুলা শুধু করোনার ক্ষেত্রেই সম্ভব, অংকের হিসাবে নয়। আজ আমার মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীর সবচে সুখি মানুষ। খুশি মানুষ। আল্লাহ পাক তাঁর অশেষ রহমতের দ্বারা আমাকে আমার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আলহামদুল্লিাহ,পরম করুনাময় রাব্বুল আলামিনের কাছে, যার দয়া ও করুনায় আমি আজ করোনামুক্ত। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবার পর থেকে সুস্থ হওয়া অবধি আমার প্রতি বেশকিছু মানুষের মানবিকতা ও ভালবাসার কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
শুরু থেকে ইউনিভার্সিটির বড় ভাই শান-এ-খুদা মানসিকভাবে খুব সাপোর্ট দিয়েছেন আমায়। বন্ধু মঞ্জু, সাগর থেকে শুরু করে আমার ছোট বোনের বর শফিক, মামা-জসিম, হাবিজ, আসাদ, হযরত, বাকি বিল্লাহ, ছোট ভাই লিটন,মশিহুর ভাই-পান্না ভাবী, ইয়াছিন ভাই, ভাইস্তা বাছির, বন্ধু ডাক্তার আব্দুর রহমান, দীন ইসলাম সহ সকলের প্রতি আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ জানাই আমার সহকর্মীবৃন্দ, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে ডিজিএম মহোদয় সহ যারা বিভিন্ন সময়ে ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন আমায়। আমার এই সংকটে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জরুরী বিভাগে নিয়োজিত আমার মহান বন্ধু ডাঃ সেলিমের অবদানের কথা কোনভাবেই বলে শেষ করা যাবেনা। রাত ১২টা কিংবা ৩টা বলে কথা না। সব সময় আমাকে সময় দিয়েছে। কখনও ডাক্তার হয়ে কখনওবা বন্ধু হয়ে নানা গল্প গুজবের মধ্য দিয়ে আমার মানসিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে খারাপ সময়গুলোতে।
সাধারণ ছুটির পর অফিসে কাজের অতিরিক্ত চাপে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মনে মনে ভাবি হয়তবা অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য এমনটা লাগছে। কাপুনি দিয়ে জ্বর, প্রচন্ড মাথাব্যথা, সর্দি-কাশি আর প্রচন্ড রকম শরীরব্যথা টের পাওয়ার পর নমুনা পরীক্ষা করাতে দিলে আমার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। আমার নিজের জন্য যতটা না ভেবেছি তার চেয়ে আমার মেয়ে নাতাশা আর স্ত্রী ইসরাতের জন্য চিন্তাটা বেশি ছিল। মেয়েটা ছোট। আর আমার স্ত্রী তখন ৯ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এরই মধ্যে মেয়ে আর স্ত্রীকে শ্বশুরের কোয়ার্টারে আলাদা একটা রুমে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দেই। শুরু হলো আমার আইসোলেশন থাকা একাকী জীবনের। শ্রদ্ধেয় মামা এম,এ কামাল বিল্লাহ’র লেখা ‘নিভৃতে নিরন্তর’ গল্পের নায়ক ইয়াকুব আলীর কোয়ারেন্টাইনে থাকার অভিজ্ঞতা টা খুব কাজে দিয়েছে তখন।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
আমার সর্দি, জ্বর, প্রচন্ড রকম গা ব্যথা, পাতলা পায়খানা আর শুকনো কাশি ছিল। এর জন্য টেলিমেডিসিন নিচ্ছিলাম। অফিস কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে জুনের ৫ তারিখে করোনা টেস্টের জন্য নমুনা দেই। রেজাল্টের অপেক্ষায় বসে থাকব, সে জো নেই। অসুস্থ শরীর নিয়েই অফিসে যেতে হয়। ব্যাংকের চাকুরি বলে কথা! তার উপর জুন মাস। জুনের ৮ তারিখ। অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। সন্ধ্যা ছয়টা। হঠাৎ একটা কল আসে আমার মোবাইলে। ‘আপনি কি ফয়সুল’। জি বলতেই ওপাশ থেকে বলল ‘ভৈরব থানা থেকে বলছি আপনি ৫ তারিখে যে নমুনা দিয়েছেন তার রিপোর্ট এসেছে। আপনি করোনা পজিটিভ’। এই খবরটার জন্য নিশ্চয়ই আমি প্রস্তুত ছিলাম না! স্বাভাবিকভাবেই একটু নার্ভাস নার্ভাস লাগছিল। হাত পা কাঁপছিল। আতঙ্কে মনে হচ্ছিল এই বোধহয় শেষ! আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন ব্যাংকার হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে কাজ করেছি।
প্রতিদিন শত শত কাস্টমারদের সেবা দিয়েছি। তার মধ্যে কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত না সেটা বুঝার কোন উপায় ছিল না। তবে সবসময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করার চেষ্টা করেছি। চারদিকে এত ব্যাংকার আক্রান্ত হচ্ছে। যেকোন সময় আমিও আক্রান্ত হতে পারি এমন একটা টেনশন মাঝে মধ্যে যে হত না তা কিন্তু নয়! তবুও ‘আক্রান্ত হতে পারি’ আর ‘আক্রান্ত হয়ে যাওয়া’ যে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস,তা টের পেলাম রিপোর্ট জানার পর। স্ত্রী ইসরাতকে যখন ফোনে সে খবরটা জানাই, অনেক্ষন ধরে ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাচ্ছিলাম না, মানে খবরটা শুনার পর ইসরাতও বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কান্নারুদ্ধ কন্ঠে শুধু বলল, আমার এই অবস্থা, আর তোমার করোনা, এখন কি হবে আমাদের? কান্না থামাতে না পেরে কল কেটে দিল। সেই মুহুর্তটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। কতোটা কঠিন, তা লিখে বা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। সেটা কেবল তারাই অনুভব করতে পারবে, যারা এর ভিতর দিয়ে যেতে বাধ্য হয় বা হবে।
আমার করোনা আক্রান্তে বেশি ভেঙে পড়েছে আমার পরিবার। যারা আমায় অনেক ভালবাসে। যারা আমার পথ চেয়ে দিন গুনেছে প্রতিটা মুহুর্তে। যারা দূর থেকে আমার সুস্থতার জন্য দিন রাত আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করেছে। আমার জন্য তাদের খারাপ চিন্তাটাও আমায় কষ্ট দেয়। আমিও সবসময় চেয়েছি আমার পরিবার ভাল থাকুক, সুস্থ থাকুক। তাই প্রতিবার অফিস কিংবা বাইরে থেকে ফিরে বাসায় ঢুকেই সবকিছুর আগে গোসল, সার্ফ এক্সেলে কাপড় চোপড় ভাল করে ধুয়ে তারপর বউ বাচ্চার কাছে যেতাম। এত সতর্ক থাকার পরও কিভাবে যেন আক্রান্ত হয়ে গেলাম। তবে এটা বুঝলাম শুধু একা নিজে সতর্ক থেকে কোন লাভ নেই। সবাইকে সচেতন আর নিরাপদে থাকার চেষ্টা করতে হবে। সবার প্রতি অনুরোধ যদি সামান্যতম উপসর্গও দেখা দেয় প্লিজ টেস্ট করাবেন। আর ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পড়বেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। নিজের ভালো থাকাটা যেমন জরুরী তেমনি আশেপাশের সবাইকে ভালো রাখাটাও আমাদের নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্ব। আর সবসময় পরম করুনাময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
আক্রান্ত হবার পর ডাক্তারদের পরামর্শে ঔষধ ও নিয়ম-কানুনগুলো কঠোরভাবে মানতে শুরু করলাম। এরই মধ্যে অনুজ খোকন আর খালাত ভাই জয় ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যা পেয়েছে তাই-ই আমার মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছে। প্রথম কদিন খুব জ্বর ছিল। তারপর কিছুটা কমে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রীর মত সবসময় থাকত। সারাক্ষণ কাশি কাশি একটা ভাব ছিল। যেহেতু এখন পর্যন্ত এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ আবিস্কার হয়নি তাই একমাত্র উপায় হলো নিজের ইমিউন সিস্টেমটাকে বুস্ট আপ করা। সে লক্ষ্যে পুষ্টিকর খাবার, ফল-মূল, আর প্রচুর লেবু খেয়েছি।
প্রতিটা দিন যেত ইমোশনে। এমনিতেই আমার ইমোশন একটু বেশি। আমার মা বাবা দুজনই মোটামুটি একটু বয়স্ক। গ্রামের বাড়ি কালিকাপুরে থাকেন। আমার করোনার কথা শুনে বাবা মা পাগলের মত ছুটে আসতে চেয়েছে আমার কাছে। অনেক কষ্টে তাদের বুঝিয়েছি, বলেছি-দূর থেকে আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর যাতে তারাতারি সুস্থ হয়ে উঠি। মা জায়নামাজে বসে আমার জন্য খুব কাঁদতেন। মা বাড়ি থেকে আমার পছন্দ করা খাবার রান্না করে ছোটভাই খোকনকে দিয়ে পাঠাতেন। প্রতিদিনই কয়েক বার করে কথা হত ফোনে বা ভিডিও কলে। মা কান্না করে, ফোন করে শুধু কান্না করে। কেন কান্না করে তা আমি জানি। কারন আজ আমিও বাবা। আমার ছোট্ট মেয়েটার জন্য আমার যেমন কষ্ট লাগছে, আমার মায়েরও আমার জন্য কম কষ্ট হচ্ছেনা নিশ্চয়। অনেক কিছু বলতে চায় মা। বাবাও অনেক কিছু বলতে চায়। ভিডিও কলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা। তাই অডিও কলই দেয় বেশি। সারাক্ষন একাকী থাকি বাসায়। মাঝে মাঝে খুব মনে হত যদি এমন হয় আমি আর কোন দিন তাদের সামনে থেকে দেখতে পাবনা আমার মা বাবাকে, আদরের পিচ্ছি ছোট বোনটাকে, ছোট ভাইটাকে, আমার কলিজার টুকরা মেয়ে নাতাশাকে আর প্রিয়তম স্ত্রী ইসরাতকে।
বার বার মনে হত যদি কখনো এমন হয় যে, কাশিটা আরও বেড়ে গেল, শ্বাস কষ্ট টা ও বেড়ে গেল। তখন তো হসপিটালাইজড হতেই হবে আমাকে। আইসিইউ তেও যাওয়া লাগতে পারে। আর সেখান থেকে হয়তবা আর ফেরা হলোনা আমার। আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে উপরেই চলে যেতে হল আমাকে। এই ফিলিংস গুলো যে হত না তা কিন্তু নয়। পরক্ষনেই নিজেকে একটু ভিন্ন দিকে ডাইভার্ট করে নিজেকে অন্য দিকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতাম। ছোটবেলার থেকে এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া জীবনের ভাল স্মৃতি গুলোকে চোখের সামনে ভাসিয়ে রাখতাম। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষন? এই যে ছোট্র এই বাসাটাতে আছি আজকে এক মাসের উপর হতে চলল। দুই রুমের ছোট্র একটা ফ্ল্যাট বাসা। এক চিলতে বারান্দা। যখন শরীরটা একটু ভাল ফীল করি বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসি। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা ছোট রাস্তা। রাস্তায় মানুষদের দেখি কত প্রানবন্ত। তখন শুধু মনে মনে ভাবতাম সুস্থতা আল্লাহ পাকের কত বড় নিয়ামত! প্রতি মুহুর্তে আমরা তার দেয়া শত কোটি নিয়ামত ভোগ করছি কিন্তু কতবার তার শুকর গুজারি করেছি।
টেলিভিশন খুললেই খারাপ নিউজ। ওমুক সাবেক মন্ত্রী মারা গেল, তমুক মন্ত্রীর বউ মারা গেল, ওমুক সচিব মারা গেল, তমুক মেয়র মারা গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব নিউজে মানসিক চাপ বেড়ে যায়। তাই ডিশের লাইনটা খুলে রেখেছি। ফেসবুকে ঢুকলেই দেখি-করোনা সন্দেহে বাবা মা তাদের আদরের ১০ বছরের ছেলেটিকে রাতের আঁধারে বাড়ির পাশের জঙ্গলে ফেলে রেখে গেছে। ছেলে করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছে আবার করোনা আক্রান্ত বাবার লাশ নিতে সন্তান্দের অস্বীকৃতি। কত নির্মম, কত নিষ্ঠুর হলে এসব করা সম্ভব! করোনা সত্যিই আজ এমনই এক অচেনা নতুন পৃথিবীর মুখোমুখি করেছে আমাদের।
ফেসবুকে তেমন ঢুকিনা, টেলিভিশনেও খবর দেখিনা। চারদিকে এত মৃত্যু আতঙ্ক। আল্লাহ্ পাক যেন সবাইকে জান্নাতবাসী করেন। আমীন। তবে ম্যাসেঞ্জার আর ফোন টা খোলা রাখতাম সবসময়। এই সময়ের সঙ্গী স্মার্ট ফোনটাতে বসে বসে ইসলামিক ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক, সিনেমা দেখি। আর সময়ে সময়ে টুকটাক লেখালেখি করে সময় পার করি।
আমার বাসাটার বারান্দার দশ ফুটের মত দূরেই একটা পুকুর। গ্রীষ্মে তেমন পানি থাকেনা। বোরো ধানের চাষ হয়। আষাঢ়ের এই সময়টায় পুকুরটাতে বেশ পানি। পুকুরটার ঠিক মাঝখানে কচুরিপানার একটা বেড়ি জমা আছে। সেখানটায় একটা ধল বক প্রায়ই বসে থাকে শিকারের উদ্দেশ্যে। বারান্দার লাগোয়া মেহগনি গাছটায় প্রচুর মাছরাঙা বসে। প্রতিদিন মাছরাঙাদের কিরকিরানি শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আমার। সন্ধ্যা নামতেই বাসার অদূরে বিএডিসি’র বাগানবাড়ি থেকে শেয়ালের খুব ডাক শুনা যায়। আমার মেয়েটা শিয়ালের খুব ভক্ত। এতটাই ভক্ত যে মাঝে মাঝে নিজের মামাকেও শিয়াল মামা বলে ডাকে। শিয়ালের ডাক খুব উপভোগ করে আবার ভয়ও পায়। শিয়ালের ডাক শুনে দৌড়ে এসে আমায় ঝাপিয়ে ধরতে ধরতে বলে আব্বু শিয়াল ডাকছে।
-তাতে কি হয়েছে মা? শিয়াল কে তো তুমি মামাই বল। শুনতে একটু অদ্ভুত মনে হলেও শিয়ালের ডাকের ওই ভয়টাই আমার মেয়ে খুব উপভোগ করে। এখন শিয়াল খুব ডাকছে। মেয়েটা বাসায় থাকলে আজও ভয় পেয়ে আনন্দে আমায় জড়িয়ে ধরত। কথাটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। খুব বেশি মনে পড়ত ছোট্ট ছোট্ট পায়ে নাতাশার এ রুম ও রুমে দৌড়ানো, খেলনার পুতুল, হাড়ি পাতিল নিয়ে রান্না করা আর সেই রান্না আমাকে চেখে দেখানো।
ফজরের নামাজ শেষে একটু ঘুমিয়ে নিতাম। ঘুম ভাঙ্গার পর প্রতিদিন সকালে বারান্দার দরজাটা মেলেই একপলক দেখে নিতাম বাহারি রঙের সেই সব মাছরাঙাদের। এরপর সাবান পানিতে হাত মুখ ধুয়ে একটা বিস্কুট খেতে খেতে দিনটা শুরু হত আমার। লবন মিশ্রিত গরম পানিতে গার্গল করা। আদা, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, কালজিরা ও লেবুর রস মিশ্রিত গরম পানির ভাপ নেয়া। প্রতিদিন কিছু শারীরিক ব্যায়াম বিশেষ করে ফুসফুস এর ব্যায়াম নাক দিয়ে বড় করে শ্বাস নিয়ে কিছুক্ষন শ্বাস আটকে রেখে মুখ হা করে জুড়ে ছেড়ে দিতাম সেই প্রশ্বাস। ডাক্তাররা বলে এর ফলে ফুসফুসের এলভিওলাস বেশি প্রসারিত হয় আর ব্লাড সার্কুলেশনও বেড়ে যায় নাকি। সকালের নাস্তা শেষে বারান্দায় বসে গ্রীন টি খেতে খেতে বাইরের মানুষদের দেখতাম। একটু দূরে একটা ডেয়রি ফার্ম। পশুপালন নিয়ে পড়াশোনা করেছি ত তাই খুব আগ্রহ নিয়ে ডেয়রি ফার্মটাকে দেখতাম। গলা ভেজা রাখতে লেবু, মালটার রস করে খেতাম। মুখে রুচি, স্বাদ গন্ধ না পেলেও জুর করে পেট ভরে খাওয়ার চেষ্টা করেছি।
এভাবেই কাটতে থাকে আমার করোনাময় জীবন। প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় যতখন তখন। ঘরে বসে বসে সারাদিন আর কত ভাল লাগে। একটা অচেনা অজানা আতঙ্ক ত আছেই। আর পারছিনা। ক্লান্ত লাগছে খুব। প্রিয় কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর কবিতার কয়েকটা লাইন হৃদ মাঝারে খুব বেজে যাচ্ছে-
“আমি একা
এই ব্রহ্মান্ডের ভেতর
একটি বিন্দুর মত
আমি একা”।
ঘুম থেকে উঠে উত্তরের জানালার থাই গ্লাসটা ধাক্কা দিতেই চোখ পড়ে পাশের রেইন ট্রি গাছটায় বসে থাকা বিষন্ন কাকটির উপর। আজ সে বড়ই কু ডাক ডাকছে। পুকুরের মাঝের বেড়িতে ধল বকটাকেও দেখছিনা। মাছরাঙ্গা গুলোও কিরকির শব্দ করছেনা। সবাই চুপ করে মেহগনির ডালে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। সকাল থেকেই শরীরটা কেমন জানি লাগছে।
জুনের ১৫ তারিখ। তখন সন্ধ্যা ৬টা। একটা কল আসে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি আমার স্ত্রীর কল। কলটা রিসিভ করতেই আমার হাত পা সব জমে ঠান্ডা হয়ে গেল। আমার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী ওপাশ থেকে বলছে, ‘দুপুর থেকে আমার ত খুব খারাপ লাগছে। তুমি টেনশন করবা তাই তোমাকে বলিনি, ভাবছি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে’। একজন অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীর এই শেষ সময়ে খারাপ লাগার কারন টা বুঝার বাকি রইল না আমার। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এমন সময়ে স্ত্রীর পাশে থাকা প্রত্যেক টা স্বামীর জন্য ১৪৪ ধারার চেয়েও জরুরী। কিন্তু আমি…?। আমার ত একেবারেই হাত পা বাঁধা। শশুরকে কল দিয়ে বললাম প্রয়োজনীয় সব কিছু করতে। সংকটের এই সময়ে গাড়ি পাওয়া খুবই দুরুহ ব্যাপার। শেষমেশ ইউএনও স্যারের বদান্যতায় উনার গাড়িতে করেই জহিরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হলো ইসরাতকে।
এদিকে আমার অবস্থাও খুব একটা ভাল না। এমনিতেই সকাল থেকে শরীর টা খারাপ যাচ্ছে। একদিকে অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী অন্যদিকে আমার ছোট্ট মেয়েটা। আমরা তিন জন তখন তিন জায়গায় আটকে গেছি। আমার প্রেসার বেড়ে গেছে। চরম উৎকণ্ঠায় হাত পা সহ সারা শরীর কাঁপছে। ওদিকে হসপিটালের ডাক্তার বলছে দ্রুত সিজার করাতে হবে। ব্লাড লাগবে দুই ব্যাগ। কিন্তু ব্লাড পাওয়া যাচ্ছেনা। শশুর একা এদিক ওদিক ছুটছে ব্লাডের জন্য। ভার্সিটিতে পড়ার সময় কত ছোট ভাইকে নিজ খরচে ব্লাড দিতে নিয়ে যেতাম। আজ ব্লাডের অভাবে আমার স্ত্রীর সিজার করতে দেরি হচ্ছে। দেরি মানেই ত আরও বিপদ। বন্ধু মঞ্জু আর সেলিম তখন মানসিকভাবে আমায় খুব সাপোর্ট দিয়েছে। অবশেষে আমার মামা শশুর উজ্জ্বল ব্লাড ম্যানেজ করে। রাত ২টার দিকে আমার স্ত্রীর সিজার হল। শাশুরি ফোন দিয়ে জানাল ‘তুমার মেয়ে হয়েছে’।
আলহামদুলিল্লাহ। এখন আমার দুই মেয়ে। আল্লাহ্ পাক আমায় দুইটা জান্নাত দিয়েছেন। ওই রাতে খুব ভাল ঘুম হয়েছিল আমার। প্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এর ছোট মেয়ের নামের সাথে মিল রেখে আমার মেয়ের নাম রাখলাম ‘ইরাম’ যার আরবি অর্থ জান্নাত। ইরামের জন্মের ওই সময়টায় আমার অনুপস্থিতিতে শ্বশুর-শাশুরি, উজ্জ্বল মামা, রিয়াদ সারা রাত না ঘুমিয়ে হসপিটালের বারান্দায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
ফুলের মধ্যে জুই কখনোই আমার পছন্দের ছিলনা। কিন্তু আমার এই দুঃসময়ে জুই নামের এই মেয়েটি যেন ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। জুই এর জন্যই খাবার দাবার নিয়ে আমার একটুও কষ্ট পেতে হয়নি। কোয়ার্টার থেকে প্রতিদিন কত কষ্ট করে বাইরের শত ঝুঁকিকে ওপেক্ষা করে আমার দরজার সামনে খাবার দিতে এসে বলত-‘নাতাশা খেতে চায়না, শুধু বলে আম্মু বাসায় আসলে খাব। সারাদিন বারান্দায় বসে রাস্তায় তাকিয়ে থাকে আপনারা কখন আসেন সেই অপেক্ষায়’। ফোন ধরেই আমার মেয়েটা যখন বলত ‘আব্বু তুমি কোথায়? তোমাকে দেখিনা। তুমি আসোনা কেন? জানো আব্বু- আম্মু বাবু আনতে হসপিটালে গেছে। এখনও আসছেনা কেনো’? সেই সময়টার কথা মনে হলে এখনও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা। আমার স্ত্রীর সিজারের সেই সময়টায় আমার ছোট্ট মেয়েটিকে কত যত্নে আগলে রেখেছে জুই। আমাদের জন্য তার ত্যাগ, তিতিক্ষা আর পরিশ্রম দেখে কখনও মনে হয়নি সে আমার শ্যালিকা; ঠিক যেন আমার সহোদর ছোট বোনটি। আল্লাহ্ পাক যেন তাকে উত্তম প্রতিদান দেন। ফুলের মতই সুন্দর হোক তার জীবন। এরই মধ্যে জুনের ২০ তারিখে দ্বিতীয়বারের নমুনা পরীক্ষায়ও আমার রিপোর্ট পজিটিভ আসে।
মাঝে মাঝে এই ভেবে খুব খারাপ লাগতো যে,জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার করে ফেলেছি অথচ মানুষ আমায় মনে রাখবে এমন কোনো কাজ এখন পর্যন্ত করতে পারিনি। তবে এতটুকুন বলতে পারি আমার দ্বারা কারো কোন ক্ষতি হয় নাই। পেশাগত দিক থেকে সব সময় মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আর ভুল করে কাউকে আঘাত দিলে, পরক্ষণেই নিজে অনুতাপে পুড়েছি, ক্ষমা চেয়েছি। বিপদে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।
আমার করোনা আক্রান্তের কথা শুনে খুব কাছের অনেকেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে আমার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে! ফোন করে খোঁজ নিতেও ভয় পেয়েছে কেউ কেউ। একটা কথা খুব মনে হয়েছে তখন-বিপদে পড়লেই কেবল বুঝা যায় কে কাছের আর কে দূরের? অনেকে তখন আরও কাছে চলে আসে; আবার কেউ কেউ দূরে চলে যায়, বহুত দূরে, খুব রঙ বদলায়; যা দেখে গিরগিটিও লজ্জা পায়। তবে কারো উপর কোন অভিযোগ নেই আমার। হয়তবা এটাই জগতের নিয়ম।
অবশেষে জুলাইয়ের ৫ তারিখে তৃতীয়বারের নমুনা পরীক্ষায় আমার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। আলহামদুলিল্লাহ্ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুস্থ আছি। মহান আল্লাহ্ পাকের কাছে এমন একটা পৃথিবী চাই যেখানে সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে বাসায় ফিরে বাবা তার ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে ইচ্ছে মত চুম্বন করতে পারবে। যেখানে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন শব্দ গুলো পৃথিবীর বুকে কার্যকারিতা হারাবে।
লেখক পরিচিতিঃ
ফয়সুল আলম- জন্ম ১ মার্চ, ১৯৮৭ ভৈরবের কালিকাপুর গ্রামে। পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশুপালনে অনার্স ও পশুবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। লেখালেখির শুরু স্কুলজীবন থেকেই। প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘তিন ঘন্টার কারাগারে’। দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করেন। পরিবেশ, অর্থনীতি, নাগরিক ও ব্যক্তি জীবনের নানাদিক তার লেখার উপজীব্য বিষয়।